বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ , ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
মানচিত্র

এক সময়ের সবচেয়ে ধনী দেশ মালি

নিউজজি ডেস্ক ২২ সেপ্টেম্বর , ২০২২, ১০:৪২:২৮

624
  • এক সময়ের সবচেয়ে ধনী দেশ মালি

ঢাকা: ১৪ শতাব্দীতে ইউরোপে যখন দুর্ভিক্ষ আর খাদ্যাভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও সচ্ছল এলাকা ছিল আফ্রিকার দেশ মালি। আর ইতিহাসে গত এক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান যে ব্যক্তিটি জীবন যাপন করেছেন তিনি মালির মুসলিম রাজা ‘মানসা মুসা’। 

মালি পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম বামাকো। পশ্চিম আফ্রিকার এই বড় দেশটির উত্তরে প্রায় অর্ধেক জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। দেশের বাকি অংশ জুড়ে রয়েছে সবুজ তৃণভূমি। মালিতে উর্বর জমির অভাব থাকলেও অন্যান্য অতি মূল্যবান সম্পদ সে অভাব পূরণ করে দিয়েছে। স্বর্ণ ও লবণের খনি শত শত বছর ধরে মালির অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে। মালির উত্তরাঞ্চল থেকে বাণিজ্যপথ বর্ধিত হয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যেখানকার ধনী ব্যবসায়ীগণ ইউরোপ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পাঠানোর জন্য চড়ামূল্যে স্বর্ণ ও লবণ কিনতে আগ্রহী ছিল। এই বাণিজ্যপথগুলো মাদিনকা নামক পশ্চিম আফ্রিকার স্থানীয় গোত্রটিকে অবিশ্বাস্যরকম সম্পদশালী গোত্রে পরিণত করেছিল।

মালি’ নামক এক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন সুনদিয়াতা কেইতা নামক এক ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসে বেশ অজ্ঞাত, তার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায়না। তার জীবনের অনেক গল্প শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। যার ফলে সময়ের সাথে প্রকৃত ঘটনা বিকৃত হয়ে গিয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, একটি উপাখ্যান হচ্ছে তিনি একটি পূর্ণবয়স্ক বড় গাছ সমূলে উপড়ে ফেলেছিলেন এবং সেটা আবার তার মায়ের উঠানে রোপণ করেছিলেন)। তবে জানা যায়, তিনি মালি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন এবং ১২৩০-এর দশকে পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম জনগণের জন্য একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি “মান্‌সা” উপাধি ধারণ করেন, মাদিন্‌কা ভাষায় যার অর্থ হলো রাজা।

মালির দশম “মান্‌সা” বা রাজা ছিল “প্রথম মুসা” যিনি ১৩১২ সাল থেকে ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত মালি শাসন করেন। তাঁর ভাই মান্‌সা আবু বকর আটলান্টিক মহাসাগরে আমেরিকা আবিষ্কারের অভিযানে বের হলে মুসাকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তাঁর শাসনামল সম্পর্কে আমরা যা জানি তার বেশীরভাগই এসেছে ১৩২৪ সালে তাঁর হজ্জ পালনের ঘটনা থেকে।

একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে মান্‌সা মুসা হজ্জ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। ভৌগলিকভাবে দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত বলে মালি থেকে মক্কায় যাত্রা এখনকার আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই কঠিন, আর তখনতো ছিল সেটা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তারপরও ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে মুসা ৬০,০০০ লোকের এক বিশাল কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যেহেতু তাঁর সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর অন্যতম ধনী সাম্রাজ্যের একটি, স্বাভাবিকভাবেই সেই কাফেলা যাত্রাপথে সকলের মনে ছাপ রেখে যায়।

কাফেলায় ছিল ১২,০০০ চাকর-বাকর, প্রত্যেকের পরনে ছিল মূল্যবান সিল্কের পোশাক ও সাথে ছিল ৪ পাউন্ডের এক স্বর্ণখন্ড। ৮০টি উটের প্রত্যেকটি ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ডের স্বর্ণগুড়া বহন করছিল যেগুলো যাত্রাপথে গরীবদের মাঝে বিলানো হয়েছিল।

অভুতপূর্ব জীবজন্তু এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আনাগোনা এই কাফেলার যাত্রাটিকে মহাকাব্যিক করে তোলে এবং যে ব্যক্তিই কাফেলাটি অবলোকন করেছে তাদের মনে তা স্থায়ী ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এই জাঁকজমক কাফেলার বিভিন্ন বর্ণনা বিভিন্ন এলাকার লোকজনের মুখে মুখে চালু হয়ে যায়।

মুসার হজ্জের পর মালির যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি ঘটে তা হলো জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এর উত্থান। বিশ্বের নামকরা স্কলারদের নিয়ে মালিতে সেসময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় এবং বিকশিত হয় জ্ঞানার্জনের সংস্কৃতি।

গাও ও তিম্বুক্তু শহরগুলোতে ছিল প্রচুর লাইব্রেরী। ব্যক্তিগত ও সরকারী সংগ্রহে ইসলামী আইন, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, ভাষা, ইতিহাস থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে ছিল হাজার হাজার বই। ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তখন আফ্রিকার সকল প্রান্ত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত।

৩০০ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত দেশটি আফ্রিকার তিনটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ঘানা, মালি ও সোঙ্গাই সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১৮৯৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের অধিকারে ছিলো দেশটি। ১৯৬০ সালে মালি স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯১ সালে মালি স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয় এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন।

মালির অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ২০১১ সালে থেকে দেশের উত্তর প্রান্তে তুয়ারেগ জাতি গোষ্ঠীর বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ দমনে সরকারী ব্যর্থতার অভিযোগে মাঝা্রি পদের কিছু সেনা ২০১২ সালের ২২ মার্চ রাষ্ট্রপতি আমাদো টোরেকে ক্ষমতাচ্যূত করে সামরিক শাসন জারি করে। ইকনমি কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস'এর মধ্যস্থতায় এপ্রিল মাসে অসামরিক শাসন পুনর্বহাল হয়, অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হন ডিওনকোন্ডা ট্রারোরে।

অভ্যুত্থান পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের উত্তর প্রান্তের তিনটি অঞ্চল অধিকার করে নেয় বিদ্রোহীরা। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে অঞ্চলগুলি পুনর্দখলে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। এক মাসের মধ্যে এ অঞ্চলের অধিকাংশের নিয়ন্ত্রণ মালি সরকার ও ফ্রান্স সেনাবাহিনীর হাতে চলে আসে। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি ও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইব্রাহীম বোবাকার কিয়েতা প্রেসিডেন্ট ও মোদিবো কিয়েতা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর দি লিবারেশন অব আযোয়াদ মৌলবাদী ইসলামী গ্রুপগুলোর কাছে বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারায়। তবে ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি মালি এবং ফ্রান্সের যৌথ বাহিনী ইসলামী গ্রুপগুলোর কাছ থেকে আবারও এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তবে এখনও বিদ্রোহী গ্রুপগুলো মাঝে-মধ্যে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে থাকে। 

বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে মালিতে প্রথম শান্তিরক্ষী পাঠানো হয়। মালিতে বাংলাদেশের ১ হাজার ৭২২ শান্তিরক্ষী মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী ১৩১০, নৌবাহিনী ১৩৩, বিমানবাহিনী ১২৩, পুলিশ ১৪০ এবং স্টাফ অফিসার ১৬ জন (২০১৫)। বর্তমানে মালিতে ১ হাজার ৬৭৪ শান্তিরক্ষী মোতায়েন রয়েছে (মে ২০১৭ )।

মালি মূলত মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ। প্রতিটা শহরেই রয়েছে নান্দনিক মসজিদ। সব মসজিদেরই রয়েছে ঐতিহাসিক গৌরব। যেমন, মালিতে অবস্থিত এক শহর জ্যানি। এটি আফ্রিকার অন্যতম নির্দশন এবং সুডানো সাহেলিয়ান স্থাপত্যকর্ম এর অন্যতম উদাহরণ। বর্তমানে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভূক্ত এই শহরের মসজিদগুলো অনেক জনপ্রিয়। দ্য গ্রেট মস্ক অফ ডেন্নি, জ্যানির এই মসজিদটি ১০০ বছরের পুরনো এবং এটি ইট-কাদার তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ। একটা সময় এই মসজিদ দর্শন করার ক্ষেত্রে টুরিস্টদের নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

মালির গাও'তে অবস্থিত সব থেকে জনপ্রিয় সম্রাট ১ম আসকিয়া মোহাম্মাদের মাজার বলে বিশ্বাস করা হয়। এটা ১৫ শতকের শেষভাগে নির্মিত এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত।ইউনেস্কো সমাধি টিকে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে মৃত্তিকা নির্মিত সমাধি ভবন ঐতিহ্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। চত্বরের মধ্যে পিরামিডিয় সমাধি, দুটি মসজিদ, একটি কবরস্থান এবং জমায়েতের স্থান আছে। ১৭ মিটারের উচ্চতার সমাধি অত্র অঞ্চলের সব থেকে বড় প্রাক কলোনিয়াল স্থাপত্য সৌধ। এটা ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর প্রথম নিদর্শন যার অনুকরণে পরবর্তীতে আশপাশে আরো অনেকগুলি নির্মিত হয়। আসকিয়া নিয়মিতভাবে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটা গাও শহরের জন্য সরকারি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এই সাইট এবং এর সংলগ্ন বাফার অঞ্চল জাতীয় এবং স্থানীয় আইন দ্বারা সংরক্ষিত।

এক নজরে

পুরো নাম : মালি প্রজাতন্ত্র।

রাজধানী ও সর্ববৃহত্ শহর : বামাকো।

দাপ্তরিক ভাষা : ফরাসি।

জাতি-গোষ্ঠী: মান্দে (৫০%), ফুলা (১৭%), ভেলতায়িক (১২%), তরেজ (১২%), সংহাই (৬%), অন্যান্য (৪%)।

সরকার পদ্ধতি : ইউনিটারি সেমি-প্রেসিডেনশিয়াল রিপাবলিক।

প্রেসিডেন্ট : ইব্রাহিম বৌবাসার কেইতে।

আইনসভা : জাতীয় পরিষদ।

স্বাধীনতা : ফ্রান্স থেকে ২০ জুন ১৯৬০।

আয়তন : ১২ লাখ ৪০ হাজার ১৯২ বর্গকিমি।

জনসংখ্যা : এক কোটি ৪৫ লাখ।

ঘনত্ব : প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১.৭ জন।

জিডিপি : মোট ৪০৯৭৪ বিলিয়ন ডলার

মাথাপিছু ২ হাজার ৩৬০ ডলার।

মুদ্রা : ওয়েস্ট আফ্রিকান সিএফএ ফ্র্যাঁঙ্ক।

জাতিসংঘে যোগদান : ১৯৬০ সাল।

ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন