বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ , ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
প্রাণী ও পরিবেশ

রস-পিয়াসিদের জন্য এসেছে রসের মৌসুম

নিউজজি ডেস্ক ৪ ডিসেম্বর , ২০২০, ১৪:৫৫:২৪

15K
  • ছবি: নিউজজি

কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে মধুবৃক্ষ থেকে আহৃত এক গ্লাস কাঁচা খেজুরের রস বাংলার মানুষকে সতেজ করে তুলে। আবার এই রস জ্বাল দিয়ে খেতে দারুণ সুস্বাদু। শীতকালে এই রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালির তুলনা হয় না। শীতের পিঠা-পায়েসের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান খেজুরের রস। এই রসে তৈরি দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। যেমনি ফুটে উঠেছে কাজী নজরুলের ভাষায়-

নতুন খেজুর রস এনেছি, মেটে কলস ভরে

ও আমার রস-পিয়াসি রসিক জনের তরে।

মিঠে রোদে শীতের দিনে, তরুণ বঁধূ লও গো কিনে,

ফাগুন-হাওয়া বইবে প্রাণে, ওগো হালকা নেশার ঘোরে।

মলিন মুখে দিয়ে দেখ, নলিন খেজুর গুড়

বাহির-ভিতর হবে তাহার, মিষ্টিতে ভরপুর, ওগো মিষ্টিতে ভরপুর।

সারা বছর অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামগঞ্জের খেজুর গাছের কদর বাড়ে শীতের সময়। এখনো তেমন একটা শীতের দেখা না মিললেও এরই মধ্যে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন অনেকেই। শীত মৌসুমের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছের রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। ভরা মৌসুমে রস সংগ্রহের জন্য শীতের আগমনের শুরু থেকেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন তারা। প্রতি বছরে চার মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। একটি খেজুর গাছি আট থেকে দশ বছর পর্যন্ত রস দেয়। শীতের সময় গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ করে গুড় বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে গুড় বানানোর পাশাপাশি কাঁচা রসও বিক্রি করে।

এক সময় দিগন্ত জুড়ে মাঠ কিংবা সড়কের দুই পাশে সারি সারি অসংখ্য খেজুর গাছ চোখে পড়ত। কয়েক বছর আগেও এলাকার প্রতিটি বাড়িতে, ক্ষেতের আইলের পাশে ও রাস্তার দুই ধারে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্য খেজুর গাছ। গাছ সংকটের কারণে প্রতি বছরের মতো এ বছরো চাহিদা অনুযায়ী রস পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা অনেক গাছির।

একটা সময় শীতকালে শহর থেকে মানুষ ছুটে আসতো গ্রামবাংলার খেজুর রস খেতে। তখন রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালি গুড় তৈরি করতেন তারা। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্য সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হতে পারে। কেননা সময়ের সাথে সাথে মানুষের মানুষিকতার পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন ডিজিটালাইজেশনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

রাজধানীর কোথায় কোথায় খেজুরের রস পাওয়া যায়:

ঢাকাবাসীর জন্য খেজুরের রস পাওয়ার একমাত্র নিশ্চিত স্থান হল তিনশ ফিট রোড খ্যাত পূর্বাচল এলাকা। তিনশ ফিট রোড ধরে এগোলে পাবেন নীলা বাজার। এই বাজারে প্রায় প্রতিদিনই হাতে গোনা কয়েকজন খেজুরের রস নিয়ে বসেন। প্রতি লিটার রস বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। বিক্রি শুরু হয় ভোর ছয়টায় দিকে। টাটকা রস পেতে চাইলে সকাল আটটার মধ্যেই পৌঁছাতে হবে। নীলা বাজার থেকে মীরের বাজার যাওয়ার পথে জিন্দা পার্কের আগে ২১ নম্বর সেক্টরে মিলবে কিছু রস বিক্রেতা।

খেজুরের রস পান করার লোভটা যদি খুবই বেশি হয় তবে ভোর বেলা গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেন। গাজীপুর সাফারি পার্কের পাশেই বাঘের বাজার এলাকায় খেজুরের রস পাওয়া যাবে। দামটা এখানে কম, প্রতি লিটার ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

এছাড়া, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে রস বিক্রি করতে দেখা যায়। যেমন: তেজগাঁ খ্রিস্টান মিশনের সামনে, গুলশান ১ এর গুদারা ঘাটে, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে, মতিঝিল এজিবি কলোনির বাজারে, রমনা পার্ক ও শাহবাগ চত্বর। তবে ভ্রাম্যমান বিক্রেতাদের কোনো নিশ্চিত অবস্থান না থাকায় ভোর বেলা হয়রানি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আবার দাম বেশি, টাটকা নয়, পানি মেশায় ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।

খেজুরের রস কখন খাবেন আর কখন খাবেন না:

খেজুরের রস ভোরবেলায় খাওয়া ভাল। সারা রাত ধরে রস জমে থাকার পর সকাল সকাল এ রস খেলে উপকার পাওয়া যায়। তবে সময় যত গড়াতে থাকে, তত এতে ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়া হতে থাকে। এতে রসের স্বাদ নষ্ট হয় এবং অম্লতা বাড়ে। অন্ধকারে এই প্রক্রিয়া কম হয়, কিন্তু দিনের আলোতে গাঁজন বেশি হয়। তাই দিনের বেলা রস খাওয়া ঠিক নয়। এতে বমিসহ পেটের নানা সমস্যা হতে পারে।

একজন সুস্থ মানুষ কতটুকু রস খাবেন:

একজন সুস্থ মানুষ সকালে এক থেকে দুই গ্লাস রস খেতে পারেন। সকালে খালি পেটে খেলে সমস্যা নেই। যেহেতু এটি এনার্জি ড্রিংক, তাই শরীরে শক্তি জোগাতে পরিমাণমতো রস খাওয়া ভালো। এর চেয়ে বেশি খাওয়া মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

কীভাবে খাবেন এই রস:

পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার বলেন, রাতে বা সকালে রস খেতে পারেন বা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবার খেতে পারেন। তবে রস যেহেতু খোলা অবস্থায় গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাই এতে জীবাণু থাকতে পারে। এটা অস্বাস্থ্যকর। এ জন্য রস হালকা আঁচ দিয়ে বা ফুটিয়ে নিয়ে খাওয়া ভাল। এছাড়া, রস জ্বাল দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করে খেতে পারেন।

খেজুরের রসের উপকারিতা:

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান (খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগ) শামসুন্নাহার বলেন,  খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি রয়েছে। এতে জলীয় অংশ বেশি। এটাকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’বলা যেতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে।

খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করে খাওয়া যায়। খেজুরের গুড়ে আখের গুড়ের চেয়ে বেশি প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল রয়েছে। গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যাঁরা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাঁদের জন্য দারুণ উপকারী। খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে। রস ও গুড়—দুটোই তাঁরা খেতে পারবেন। এছাড়া, সকালের নাশতায় খেজুর রসের সিরাপ দিয়ে রুটি খেলেই বেশি তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব।

খেজুরের রসের যেমন উপকারিতা তেমন অপকারিতাও আছে:

খেজুর রসের একটি মারাত্মক অপকারিতা রয়েছে, আমরা অনেকেই তা অবগত নই। গাছিরা বিকেলে খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি লাগিয়ে আসে। হাঁড়ি সর্বত্রই খোলা অবস্থায় থাকে। রাতে হাঁড়িতে বাদুড় এসে বসে এবং রস পান করে। তখন রসের সঙ্গে বাদুড়ের মুখনিঃসৃত লালা মিশে যায়। এভাবেই বাদুড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে নিপাহ নামের ভাইরাস আক্রমণ করে। নিপাহ ভাইরাস একটি মারাত্মক ভাইরাস। এই ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রে রোগের সৃষ্টি করে। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে প্রথমে জ্বর আসে। একপর্যায়ে খিঁচুনি হতে পারে। কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী মারা যায় বা মানসিক সমস্যার শিকার হয়ে বেঁচে থাকে।

নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ফয়সাল আহমেদ বলেন, ভাইরাস সংক্রমণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জ্বর, মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি, মাথা-ঘোরা, শ্বাস কষ্ট, নিউমোনিয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এসব লক্ষণ দেখা দেয় এই ভাইরাসের আক্রমণে। তাই খেজুরের রস ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।

যেহেতু রোগটি বাদুড়চাটা খেজুর রস পান করার জন্য হয়ে থাকে, সেহেতু আমাদের খেজুর রস আহরণে সতর্ক হতে হবে। আসুন আমরা স্বাস্থ্যসচেতন হই, সতর্কতা অবলম্বন করি। বিশেষ করে নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

নিউজজি/ আইএইচ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন