মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০ , ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

আমার ‘ছোট ভাই’ শহীদ শেখ কামাল

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী ৫ আগস্ট , ২০২২, ১০:২১:৫৪

913
  • আমার ‘ছোট ভাই’ শহীদ শেখ কামাল

বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ আগষ্ট, বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শাহিন স্কুল থেকে এস.এস.সি (১৯৬৭), ঢাকা কলেজ (১৯৬৯) থেকে এইচ. এস.সি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি.এ অনার্স পাস করে এম.এ পরীক্ষা ১৯৭৫ সালে সমাপ্ত করেন।

 শেখ কামালের সাথে আমার পরিচয় প্রায় ৫৫ বছর আগে, বাসায় নয় রাজপথে। শেখ মুজিব তখন জেলে; আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন ও ৬ দফার পক্ষে সমর্থন তখন দানা বাঁধছে মাত্র, যা ১৯৬৯ সালে প্রচন্ডতা পেতে শুরু করে। তাকে তখন দেখেছি ঢাকা কলেজ থেকে ছাত্রদের মিছিলের অগ্রভাগে। আজও মনে পড়ে যাচ্ছে নীলক্ষেত এলাকায় একটি মিছিল থেকে- স্লোগান উচ্চারিত হলো- ‘জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুরের গোরস্থান’, কিংবা বাংলা বাজার এলাকায় ধ্বনিত হলো ‘আমরা বাঙালি, ভূট্টা খাই না।’ শেষের স্লোগানটি ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কটাক্ষ।

বলছি রাজপথেই তার সাথে পরিচয় কিন্তু আমরা পরস্পরকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি। আত্মিক ও আদর্শিক নৈকট্যের পর এবার মুখোমুখি পরিচয় হলো। আমাকে সেদিন ‘মান্নান ভাই’ সম্বোধন করেছিলেন, অপমৃত্যুর আগেও তার সে সম্বোধন অটুট ছিল। অটুট ছিল সম্মান, সমীহ ও ভালোবাসার সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় জড়িত হলেও অর্থ্যাৎ প্রকান্তরে আমি তার শিক্ষক হওয়া সত্বেও আমাদের ভাই-ভাই সম্পর্কটা অটুট ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে দু’ভাই দুই সেক্টরে থাকলেও আমাদের সম্পর্ক ছিল অভঙ্গুর। মুক্তিযুদ্ধকালে কামাল প্রধান সেনাপতির নামে চালুকৃত সি-ইন-সি স্পেশালে অন্য আরও অনেকের সাথে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন লাভ করেন এবং যুদ্ধে না জড়িয়ে নিরাপদ জীবন বেঁচে নিতে পারতেন; তিনি তা করেননি। তিনি সেনাপ্রধানের এডিসি’র ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা পথ বেচে নিলেন। এ’ব্যাপারে কর্ণেল নূরুজ্জামানের আত্মজীবনীতে তার সম্পর্কে সুউচ্চ প্রশংসা বাক্য উচ্চারিত হয়েছিল।

 সুদীর্ঘ নয় মাসের মাথায় তার সাথে ও জেনারেল ওসমানীর সাথে ষোল ডিসেম্বর দ্বিপ্রহরে কুমিল্লার সার্কিট হাউসে দেখা হলো। কিছু সময় কথাবার্তা হলো। আমাকে পূর্ববত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে জেনারেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি হেলিকপ্টারে উঠে গেলেন। আপনারা জানেন সে হেলিকপ্টারটি আক্রান্ত হয়েছিল। তবে ভাগ্যগুনে সেদিন বেঁচে গেলেও বাংলাদেশী ঘাতকদের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তিনি মা-বাবা, দুই ভাই, স্ত্রী, ভ্রাতৃবধূ ও একমাত্র চাচা শেখ আবু নাসের সহ অপঘাতে নিহত হলেন।

ঘাতকরা ৩২ নম্বরে প্রথমেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। কি ছিল তার অপরাধ? তিনি প্রয়োজনে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনীত বা উচ্চারিত কোন একটি অপকর্মের সাথে কখনও সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, বা তার বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের এ’সব কাজে উৎসাহিত করতেন না। তিনি পিতার ও পরিবারের মান-মর্যাদা নিয়ে অতি স্পর্শকাতর ছিলেন। বয়োজ্যোষ্ঠ, মুরব্বী কিংবা কোন বর্ণনার জ্যেষ্ঠদের প্রতি ছিলেন অতি শ্রদ্ধাবান। জীবনে তাকে কোন সময় উদ্ধত্যময় উক্তি কিংবা উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি, যদিও উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে তার জুড়ি তিনি নিজেই ছিলেন। তাকে ত কখনও ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ বলতে শুনিনি, শুনেছি, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই স্লোগান দিতে। অধ্যাপক আবুল ফজলের এক লেখায় দেখেছি যে তিনি শেখ কামালের ভদ্রতা, নম্রতা ও শ্রদ্ধাশীলতায় অভিভূত হয়েছিলেন, যদিও কামাল পিতৃ-পরিচয় একবারও তুলে ধরেন নি।

 তার রাজনীতি ছিল প্রয়োজনে নিবেদন। কিন্তু তার সহজাত প্রবণতা ছিল ভিন্নতর। মুক্তিসংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতি, দেশ ও পিতা-মাতাকে সম্মানিত করার সুচিন্তিত পদক্ষেপ। আসলে তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দা; সে কারনে তিনি প্রকৃত বাঙালিত্ব ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারক ছিলেন। ছায়ানটের সাথে তার ছিল সংযুক্তি। সেখানে তিনি সেতারের শিক্ষার্থী ছিলেন। মঞ্চ নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিবেদিত সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক ফোরাম, শিল্প ও সাহিত্য সংঘের সাথে ছিল তার ও আমার সংযোগ। অভিনেতা হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রচুর।

 তার ক্রিকেট ও ফুটবলের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবাদতুল্য। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়াশুনা, রাজনীতি ও ক্রীড়া সংগঠনে তার সময় কেটেছে। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের উন্নয়ন বিশেষত: তার লাইব্রেরী ও সাংস্কৃতিক কর্মাকন্ডেও তিনি ছিলেন অগ্রনী। তার সৃষ্ট আবাহনী লিমিটেড সারাদেশে আধুনিক ফুটবল ও ক্রিকেটের পথিকৃত হয়ে আছে।

 ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই তিনি একই বিভাগের ছাত্রী ও দেশ-বরেণ্য ক্রীড়াবিদ সুলতানার সাথে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমন নিশ্চিত ছিল। দিন, রাত তাকে দেখেছি সে আগমন সফল করার জন্যে কায়িক ও মনস্তাত্বিক যোগ সাধনে। সে কালো রাতে তার বাসায় ফেরার কথা ছিল না। শেষ পর্যন্ত মা-বাবা ও ভাইদের টানে এলেন এবং সবার আগেই আত্মহুতি দিলেন। তাকে নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা বা নিন্দুকেরা কত-অকথা অশ্রাব্য বাক্যবান উচ্চারন করেছে। সময় প্রমান করেছে তিনি সে সবের উর্ধ্বে ছিলেন।

সময় প্রমান করেছে তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্ভিক, বন্ধুবৎসল, বয়স্কদের প্রতি অতি শ্রদ্ধাশীল। তার সৃষ্টিশীলতা ছিল নজর কাড়া। তাকে কখনও দেমাগ বা অহম তাড়িত দেখিনি। অহমিকা বা দাম্ভিকতা বিন্দুমাত্র তাকে কখনও স্পর্শ করেনি। ইচ্ছে করলে তিনি সেনাবাহিনীতে থেকে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারতেন। তিনি যদি বর্তমান ধারার অনুসারী হতেন তাহলে ছাত্রলীগের উচ্চ পদে আসীন  হতে পারতেন। তিনি ছিলেন তার নিজ অঙ্গনে। বেঁচে থাকলে তিনি হতেন সবার নয়নমনি। কালে হয়ত হতেন প্রাত:স্মরণীয়; বেঁচে থাকলে হতে পারতেন বোনের সুযোগ্য সহযোগি। ঘুচাতে পারতেন নেতৃত্বের সংকট। 

তিনি ছিলেন কথায় ও কাজে অভিন্ন। হাস্য-কৌতুক-আদর আপ্যায়নে পারঙ্গম ও দরাজ দিল। বয়স্কদের প্রতি যেমন ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, অমায়িক, ভদ্র, ন¤্র, সহপাঠি বা বয়ঃকনিষ্ঠদের প্রতি ছিলেন বাৎসল্য ভরা। প্রচার বিমুখতা ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এমন নিরংঙ্কার, নির্লোভ, উদার, অমায়িক ও সৃষ্টিশীল একজন মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া জঘন্য ও অমার্জনীয় অপরাধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ঘাতকরা শুধু আমাদেরকে পিতৃহারা, মাতৃহারা করেনি, করেছ ভ্রাতৃহারাও। জাতি বঞ্চিত হল একজন চৌকষ মানুষের সেবা থেকে।

আজকের দিনটি অর্থ্যাৎ তার ৭৩তম জন্মদিনটি আমাদের আবেগ, আনন্দ ও উচ্ছাসময় হবার কথা ছিল, হয়েছে বেদনাবিধূর। আনন্দের ছায়াটি মিয়িয়ে গেল বেদনার প্রলম্বিত অপছায়ায়। মহান স্রষ্টা যেন তাকে, তার পরিবারের শহীদ সদস্যগণ এবং মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধের সকল শহীদদের শান্তিময় আবাস নিশ্চিত করেন। 

*বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর উপাচার্য।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন