শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ , ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’

তোফায়েল আহমেদ ১৭ মে , ২০২২, ১৪:৩৮:৩১

783
  • ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’

বাংলার গণমানুষের নন্দিতনেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ চারটি দশক নিষ্ঠা ও সততার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে, অত্যাচার-অবিচার, জেল-জুলুম সহ্য করে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে, গণরায়ে অভিষিক্ত করে চারবার সরকারে অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যােগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী বিশ্বাসঘাতকের হস্তে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সময় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। তারপর থেকে দেশ ও আওয়ামী লীগ যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তখন সামরিক শাসকের দুঃশাসনে নিপতিত। ৮১-এর ১৭ মে নির্বাসন শেষে স্বজন হারানাের বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। যেদিন প্রিয়নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না, ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। ‘৮১-এর সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে যাবে। আমরা জীবন-পণ চেষ্টা করে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করে তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছিলাম দলের রক্তেভেজা সংগ্রামী পতাকা। যেদিন তিনি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনে করেছিল শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই ফিরে পেয়েছে। স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথযাত্রী।

৮০ সনের ডিসেম্বর মাসে দলের আহ্বায়ক কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৮১-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। পরে ৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে অনেক আলাপ-আলােচনার পর জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আমরা সাব্যস্ত করি মহান জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সগ্রামী পতাকা তাঁরই হাতে তুলে দেবো। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেননি তিনি, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের বৃহত্তর ও মহত্তর প্রয়ােজনে তাঁর আগমন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ। নেতৃত্ব গ্রহণের পর তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েই তিনি রাজনীতি করছেন। কোনাে পদ বা ক্ষমতা নয়, বরং বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেই দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তাবে শহিদের রক্তে ভেজা দলীয় ও জাতীয় পতাকা স্বহস্তে তুলে নিয়েছেন। প্রমাণ হয়েছে সেদিনের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত আমাদের সিদ্ধান্তটি ছিল ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। নবপ্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই কত আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। ৭৫-এর পর কঠিন সময় অতিক্রম করেছি আমরা। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নানারকম ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সফলভাবে কাউন্সিল অধিবেশন সম্পন্ন করার মাধ্যমে কায়েমীস্বার্থবাদী চক্রের একটি ঘৃণিত চক্রান্ত আমরা ব্যর্থ করতে পেরেছিলাম। কাউন্সিল অধিবেশনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা একটি বার্তা প্রেরণ করে বলেছিলেন ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান’। বার্তাটি সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।

দলের শীর্ষ পদ গ্রহণে তাঁর সম্মতিসূচক মনোভাব সম্পর্কে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে আমি বলেছিলাম, ‘আমরা সকলেই একটি সুসংবাদের অপেক্ষায় আছি। শেখ হাসিনা তার বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি সােনার বাংলা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরােধী স্বৈরশাসকের ভিত কেঁপে উঠেছিল। সেদিন স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নির্দেশে শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমরা। এরপর এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বৃষ্টিমুখর দিনে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ওইদিন ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে সে-সময়ের ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বিকাল সাড়ে ৪টায় এসে পৌঁছেন। সারাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়। ওই সময় লাখো জনতা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিল, ‘শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা-স্বাগতম’; শেখ হাসিনা তােমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেবা’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি। তােমার সাথে’; ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেবাে না’; ‘আদর্শের মৃত্যু নেই, হত্যাকারীর রেহাই নেই’; ‘মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’। সেদিন শেখ হাসিনা বিমান বন্দরে অবতরণের পর লক্ষ লক্ষ লােক তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুই যেন তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যার বেশে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আমরা যখন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে যাই রাস্তার দুপাশে লক্ষ লক্ষ লােক। এমন একটা দৃশ্য যা বর্ণনাতীত। সেখানে মঞ্চে উঠে তিনি শুধু ক্রন্দন করলেন ।

তিনি বলেছিলেন আমি সর্বহারা। আমার কেউ নাই। আপনাদের মাঝেই আমার হারানাে পিতামাতা, আমার ভাই, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আমি খুঁজে পেতে চাই। আপনাদেরকে কথা দিলাম এই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সর্বস্তরের জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতাদানকালে তিনি কয়েকবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাতির কাছে যে অঙ্গীকার তিনি সেদিন ব্যক্ত করেছিলেন স্মৃতির পাতা থেকে তা পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরছি। দূরদর্শী ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাভরা কণ্ঠে প্রাণের আবেগ থেকে তিনি সেদিন বলেছিলেন আজকের জনসভায় লাখাে চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই, আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আপনাদের কাছে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বােন। হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার-পরিজন হত্যা করে বলেছিল জিনিসপত্রের দাম কমানাে ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কী? নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পওয়ানা পাচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বেও দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না আর। এক শ্রেণির লোকে প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে। ক্ষমতার গদি পাকাপােক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শােষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শােষণের মুক্তি। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই। স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতাবিরােধীদের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ওদের রুখে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযােদ্ধারা নিজদের ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি। আপনাদের ভালোবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের সগ্রাম শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘােষিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়ন ও শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা না পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের ভার সরকারের কাছে নয়, আমি আপনাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর সামরিক শাসনবিরােধী তুমুল গণআন্দোলন সংগঠিত করেন। তৎকালীন সামরিক শাসকের নির্দেশে ৮৩-এর ফেব্রুয়ারিতে তাকেসহ আমাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সামরিক গোয়েন্দারা চোখ বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং বিনা কারণে একটানা ১৫ দিন সেখানে আমাদের আটকে রাখা হয়। ৮৪-এর ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বরে তাকে পুনরায় গৃহবন্দি করা হয়। ৮৫-এর মার্চে তাঁকে তিন মাস এবং আমাকে ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জাতীয় সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী থাকা সত্ত্বেও ৮৬-এর নভেম্বরের ১০ তারিখে তিনি যখন সচিবালয় অবরােধ কর্মসূচীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন পুলিশ তার প্রতি গুলিবর্ষণ করে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গাড়িতে উপবিষ্ট থাকা অবস্থায় তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে এবং পরদিন ১১ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১ মাসের আটকাদেশ দেয়া হয়। ৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাঁকে হত্যার উদ্দেশে তাঁর গাড়ি বহরে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষায় প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী প্রাণ বিসর্জন দেন। ৯০-এর ২৭ নভেম্বর স্বৈরাচার কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘােষণার পর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। কিন্তু প্রবল গণরােষের ভয়ে সামরিক সরকার ঐদিনই তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ৯১-এর ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৯৪-এ তাঁর আহ্বানে ট্রেনমার্চের সময় ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের উত্তরপ্রান্তে বন্দুকধারীরা তাঁর কামরা লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। সেদিনও তিনি সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।

২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ও নিউইয়র্ক টাইমসের ১৪-১৫ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি থামব না, এসব ষড়যন্ত্র উদ্‌ঘাটন করতেই হবে। আমি নিজের জীবনের জন্য ভীত হয়ে পড়লে গােটা জাতি ভীত হয়ে পড়বে। আমি জানি, কিছু বুলেট আমায় তাড়া করছে। সত্যিই ঘাতকের চোখ শেখ হাসিনার ওপর থেকে সরে যায়নি। ঘাতকের সর্বশেষ নিষ্ঠুর আঘাত এসেছিল ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে।

সেদিন নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবন দিতে হয়েছে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মীকে। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে সর্বমোট ১৯ বার হামলা হয়েছে। অকুতোভয় শেখ হাসিনার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মতোই অসীম সাহসী। সত্যিই চিত্ত তার ভয় শূন্য!

তার নেতৃত্বে একটানা বহু বছর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন এক জন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) হিসেবে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও কাছে থেকে কাজ করেছি। এছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি।

আমার বারবার মনে হয়েছে যখন তাঁর কাছে বসি বা ক্যাবিনেট মিটিং করি বা সভা-সফর করি, তখন বঙ্গবন্ধুর কথা আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই পালন করতেন। একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার সাথে আপোশ করতেন না এবং ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও মাথা নত করতেন না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জাতির পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই আদর্শ অর্জন করেছেন। তিনিও লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করেন এবং সেই লক্ষ্য পূরণে থাকেন অবিচল। ৮৬তে তিনি প্রথম নির্বাচন করেন এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। ৯১তেও বিরােধী দলীয় নেতা হিসেবে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। তারপরে মাগুরার একটি উপনির্বাচনে বিএনপি যখন পরাজিত হতে চায়নি এবং জোর করে ভােট ডাকাতি করেছিল তখন বাধ্য হয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে আন্দোলন করে বিজয়ী হয়ে ৯৬-এ দীর্ঘ ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, সেদিন শেখ হাসিনার হাতে যদি আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দেয়া না হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হতো না। ৯৬তে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত করেছিলেন তিনি। ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া সেই বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ২০০৯-এ সরকার গঠন করে সেই বিচারের কাজ শেষ করে আদালতের রায় বাস্তবায়নের পথ করে দেন। বাংলার মাটিতে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। যেখানে বেগম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী—মানবতাবিরোধী অপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলার মানুষকে কলঙ্কমুক্ত করে চলেছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোনে অনুরােধ করে কাদের মাল্লোর ফাঁসির আদেশ রহিত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেননি। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে শির উঁচু করে চলার অগ্রপথিক তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে আমরা যদি দেশের উন্নয়নের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, বিস্ময়কর উত্থান এই বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছি। এই একটি কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম অনন্য উচ্চতায় উঠেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে। মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এর বিনিয়ােগকৃত অর্থ উঠে আসবে ও বাকি ৮ বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। এর আগে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার নেশন’ হিসেবে আমরা বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য হয়েছি। আর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত একটানা ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চমৎকার। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়। নােবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক সূচকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।

পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরেও দৃঢ়তার সাথে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩,২০০ থেকে ২৫,২৩৫ মেগাওয়াট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩.৫ থেকে ৪৬.০৮ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি আয় ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে; পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৮ শতাংশ করে।

জনগণের মাথাপিছু আয় আজ ২,২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সবল-সমর্থ আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করার ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৩ নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়ে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।

সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের এসব কৃতিত্বের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ১৪টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এতো উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘােষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন না বাস্তব।

ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করেছি। ২০২০ থেকে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ এবং ২০২১ থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর সুবর্ণ জয়ন্তী সারাদেশে সগৌরবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন।

এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেন নাই। সেই কাজটি দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার সাথে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। ধীরে ধীরে যেমন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা সেই পথেই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। মানবসূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।’ ইতোমধ্যে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষণা করেছে। সুতরাং, সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আজ আমরা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে, শিল্প ও কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, নারীর। ক্ষমতায়ন হয়েছে। বিদ্যুতের আলােয় আলােকিত গ্রামগুলো শহরে রূপান্তরিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা যখন যাই তখন আমাদেরকে যারা একদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে, ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।’

২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং নিষ্ঠার সাথে দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে পরিচালিত করেছেন তিনি। শেখ হাসিনা আজ শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ও সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। ৭৩-এ আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। জাতির পিতার কন্যা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মহান ব্রতে সেই কথা বারবার প্রমাণ করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘আমি বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করে সে অর্থ দিয়ে দরিদ্র দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

বর্তমানে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা বিপুল অর্থের এক-দশমাংশও যদি জনগণের জন্য খরচ করা হয়। তবে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য মুছে যাবে এবং তাতে বৃহৎ শক্তিবর্গেরও মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গবন্ধুকন্যাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পিতার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে চলেছেন।

প্রিয় মাতৃভূমির স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেছিলেন, ৫০ বছরের গ্যাসের মজুত না রেখে আমি গ্যাস রপ্তানি করব না। সেই অঙ্গীকার তিনি সমুন্নত রেখেছেন এবং দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ৯৬-এ তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভের পর পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেছেন। ৯৮-এর বন্যায় ভিজিএফ কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে বন্যার্ত প্রায় ৩ কোটি মানুষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ করেছেন। যা বিশ্বের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। ফারাক্কার পানি বণ্টনে বঙ্গবন্ধু সরকার শুষ্ক মৌসুমে পেয়েছিল ৪৪ হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা। সেই পানি কমতে কমতে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ৯ হাজার কিউসিকে নেমেছিল।

২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনায় সুযােগ পেয়ে শেখ হাসিনা প্রথমেই পানি সমস্যার সমাধানে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী পাওয়ার কথা ৩৪,০০০ হাজার কিউসেক, অথচ তার সুযােগ্য নেতৃত্বে শুষ্ক মৌসুমে ৬৪ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুর মতাে শেখ হাসিনারও রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। তিনি আজ ৪০ বছর আওয়ামী লীগের সভাপতি; দীর্ঘ কালপর্বে বহু বাধার প্রাচীর তাকে টপকাতে হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন আওয়ামী লীগের ঘাের সমর্থকও মন করত আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন; রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তি যেন এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু শেখ হাসিনার বাস্তবােচিত কর্মতৎপরতায় আওয়ামী লীগ ৪ বার গণরায় নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছে। আজ সমগ্র বিশ্বে বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনের পথিকৃৎ বাংলাদেশ। ৯৬-এ আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে তখন দেশের খাদ্যঘাটতি ছিল ৪০ লাখ মেট্রিক টন। সেই খাদ্যঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশকে তিনি উন্নীত করেছেন খাদ্য রপ্তানীকারক দেশে। ধান, গম ও ভুট্টা জাতীয় ফসলে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই অগ্রসরমান বাংলাদেশ।

বর্তমান বিশ্বে প্রতি হেক্টর জমিতে গড় উৎপাদন প্রায় ৩ টন আর বাংলাদেশে তা ৪.১৫ টন। ২০১৪-এর ৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো প্রধান ইরিনা বােকোভা শেখ হাসিনার হাতে ‘শান্তি বৃক্ষ’ পদক তুলে দেয়ার সময় বলেছিলেন, ‘সাহসী নারী শেখ হাসিনা সারা পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছেন।’ দারিদ্র্য বিমােচন, শান্তি স্থাপন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা, আঞ্চলিক শান্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যখাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমানাে এবং ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাফল্যে প্রশংসনীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশরত্ন শেখ হাসিনা এপর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিদ্যাপীঠ তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেছেন।

২০১৫-এর ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ প্রদান করা হয় তাঁকে। নির্যাতিত রােহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত হয়েছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে। সম্প্রতি ভারতের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর সফলভাবে ভারতের সাথে সীমান্তচুক্তি ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণচুক্তি করেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শির সমুন্নত রেখে তিনি পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আসলেই শেখ হাসিনা না থাকলে পদ্মা সেতু হতাে না। বঙ্গবন্ধু সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলপথ তাঁরই অবদান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে অতিকায় সব মেগা প্রােজেক্ট । পদ্মা রেলসেতু সংযােগ প্রকল্প, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল মৈত্রী সুপার। থার্মাল পাওয়ার প্রােজেক্ট, মাতারবাড়ি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রােজেক্ট, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল, সােনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকা।

ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প তথা মেট্রো রেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর এবং দোহাজারী থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ, এসবই তাঁর নেতৃত্বে যুগান্তকারী কাজ। তার নেতৃত্বেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া বিদ্যুতের বিপুল ঘাটতি সাফল্যের সাথে মােকাবিলা করে জনজীবন থেকে লােডশেডিং দূর করেছেন। জনদুর্ভোগ লোডশেডিং এখন অতীতের বিষয়।

বিগত বছরে রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন। নয়নাভিরাম হাতিরঝিল প্রকল্প, চলাচলের সুবিধার জন্য নিত্য-নতুন ফ্লাইওভার, ঢাকার চেহারাই পালটে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিগত দশ বছরে দেশের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু- ১ স্যাটেলাইটের সুবিধা ভােগ করতে শুরু করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতুর কাঠামােগত অবয়ব এখন দৃশ্যমান। অচিরেই জনসাধারণের চলাচলের জন্য তা উন্মুক্ত করা হবে। ঢাকা শহর যানজট মুক্ত করতে মেট্রোরেলের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রােল মডেল। প্রতিবেশি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আগামী ৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে সুইডেনের মতাে উন্নত দেশে রূপান্তরের ঘােষণা দিলে, পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে জনৈক আলােচক ইমরান খানের উদ্দেশে বলেন, ‘সুইডেন বানাতে হবে না, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে বাংলাদেশ বানিয়ে দিন। তাহলেই হবে। বাংলাদেশবিরােধীরাও আজ বলছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের রােল মডেল। দেশে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনার দাবি অনুযায়ী ১/১১’র সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নে বাধ্য হয়েছিল। কারামুক্তির পর শেখ হাসিনা জাতির সামনে ঘােষণা করেছিলেন রূপকল্প-২০২১। জি-৭ ভূক্ত রাষ্ট্রসমূহের আউটরিচ বৈঠকে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে দেশকে এক অনন্য-উচ্চতায় তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব সম্পদের ৬৪ শতাংশের অধিকারী বিশ্বের শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রসমূহের নেতৃবৃন্দের প্রতি পরিবেশ বিপর্যয় মােকাবিলা এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদমুক্ত বিশ্ব গঠনের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিগত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারির প্রকোপে সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতি যখন সংকটগ্রস্ত, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকাশমান। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার প্রবৃদ্ধি পূর্বেও অর্জন যেমন সম্ভব হয়েছে, আশা করি আগামীতেও লক্ষ্য পূরণ হবে।

করােনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাক্সিন আনতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয় যৌথ উদ্যোগে দেশে ভ্যাক্সিন উৎপাদনেও তিনি সচেষ্ট। ইতােমধ্যে যেসব উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তাতে আগামী বছরের শুরুতে অন্তত ২১ কোটি ডােজ ভ্যাক্সিন আমাদের হাতে এসে পৌঁছবে। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, শেখ হাসিনার রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে দেশের মানুষের কল্যাণ। এই করােনা কালেও পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দুই লক্ষাধিক গৃহহীন, আশ্রয়হীন মানুষকে ঘর উপহার দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনকল্যাণে নিবেদিত থেকে যেসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছেন আমাদের কাজ হলাে তার পাশে থেকে সেসব কর্মসূচী বাস্তবায়নে তাকে অনুসরণ করা।

তিনি নিয়মিত পড়াশােনা করেন। ক্যাবিনেট মিটিংগুলােতে যথাযথ হােমওয়ার্ক করে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে মিটিংয়ে আসেন। একনেক বা ক্যাবিনেট মিটিংয়ের দু’একদিন আগেই মিটিংয়ের আলােচ্যসূচী, প্রস্তাবাবলি আমাদের ফাইলে দেয়া হয়। যখন একটি বিষয় প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়, তখন সেই বিষয়ের খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়গুলাে তিনি সভায় সবিস্তারে তুলে ধরেন এবং সঠিকভাবে প্রতিটি প্রস্তাবের উপরে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর এই অবাক করা প্রস্তুতি আমাদের মুগ্ধ করে। সারাদিন তিনি কাজ করেন। ভীষণ পরিশ্রমী, হাস্যোজ্জ্বল এবং আবেগময়ী মানুষ তিনি। ধর্মপ্রাণ হিসেবে প্রতি প্রত্যুষে তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামাজ আদায় করে তবেই তিনি দিনের কাজ শুরু করেন। পিতার মতােই গরীবের প্রতি তাঁর দরদ অপরসীম। বঙ্গবন্ধুর ফান্ড আমার কাছে থাকত। তিনি গরীব-দুখী মানুষকে অকাতরে সাহায্য করতেন। আমাকে নির্দেশ দিতেন তাদের সাহায্য করে জাতির পিতার কন্যার কাছে গরীব- দুখী মানুষ যখন হাত পাতে পিতার মতো তিনিও তাদের সাহায্য করেন। আমাদের দেশে যারা বুদ্ধিজীবী- কবি-সাহিত্যিক-সমাজসেবক, তাদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ান তিনি। একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বহু পুরস্কার এবং খেতাবে তিনি বিভূষিত। পিতা-মাতার মতাে সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত শেখ হাসিনা সংস্কৃতিবান এবং খাঁটি বাঙালি নারী।

বাংলার মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার দরদ এবং মমত্ববােধ, তাঁর জ্যোতির্ময় পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা থেকে আহরিত। তবে এটা মনে করার কোনো কারণ নাই যে, তিনি কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে পরিচিত; বরং আপন যােগ্যতায় স্ব-মহিমায় বাংলার কোটি মানুষের হৃদয়ে তিনি অধিষ্ঠিত। শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক না, আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে ইতামধ্যে বিশ্বজনমত ও নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণে তিনি সক্ষম হয়েছেন। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত প্রিয়নেত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে তাঁর দীর্ঘজীবন কামনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে নিবেদন করছি—

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী।

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন