বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

শিক্ষায় এআই ও আত্ম-যোগাযোগ: প্রযুক্তি ও মানবিকতার সেতুবন্ধন

মো. ইসহাক ফারুকী ১৮ সেপ্টেম্বর , ২০২৫, ১১:২০:৫৮

517
  • সংগৃহীত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বদলে দিচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রের চিত্র। শিক্ষাও এর মধ্যে ব্যতিক্রম নয়। হোক এডাপটিভ বা অভিযোজিত লার্নিং প্লাটফর্ম বা ইন্টেলিজেন্ট টিউটরিং সিস্টেম- এ আই এখন শিক্ষার্থীদের শেখার ধরণ বা শিক্ষকদের শেখানোর ধরণকেও বদলে দিচ্ছে। একই সাথে আত্ম যোগাযোগ অর্থাৎ আত্ম-পর্যালোচনা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ও আত্ম-প্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান বিশ্বে মানুষ নিজে কীভাবে খাপ খাইয়ে চলতে এবং জ্ঞান আহরণ করতে পারে-তা নির্ধারণ করছে এ আই এবং আত্ম-যোগাযোগ। মার্কিন প্রযুক্তি শিক্ষক জর্জ কৌরস বলেন, ‘প্রযুক্তি মহান শিক্ষকদের জায়গা দখল করবে না, বরং মহান শিক্ষকদের হাতেই প্রযুক্তির রূপান্তর হবে।’

শিক্ষায় এআই-এর সুফল

ব্যক্তিগতকৃত শেখা: ড্রিমবক্স (DreamBox) বা নিউটনের (Knewton) মতো এআই সিস্টেম প্রতি শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুসারে পাঠ বা লেসন পরিকল্পনা করে। এতে তারা নিজেরাই উন্নতি করতে পারে। বাংলাদেশেও এখন ড্রিমবক্স বা নিউটনের কাছাকাছি অনেক এ আই সিস্টেম পাঠ পদ্ধতি চালু হয়েছে। যেমন: খান একাডেমি বাংলা, আগামী এডটেক, প্রভৃতি।

অন্তর্ভুক্তি: টেক্সট-টু-স্পিচ, স্পিচ-টু-টেক্সট, ও রিয়েল-টাইম অনুবাদের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সহায়তা হচ্ছে।

তথ্য-ভিত্তিক বিশ্লেষণ: শিক্ষার্থীর অগ্রগতি নির্ণয় বা নিরূপণ করার মাধ্যমে শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ আই কার্যকর তথ্য প্রদান করে।

দ্রুত মূল্যায়ন: স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষার ফল প্রকাশের কারণে শিক্ষকদের সময় বাঁচিয়েছে। এতে তারা পড়ালেখা, পরামর্শ ও মেন্টরিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারছেন।

এআই-এর কুফল

মানবিক যোগাযোগ কমে যাওয়া: এআই-এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার দরুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। যা মানবিক ও আবেগগত বিকাশে বাঁধা দেয়। 

অসাম্যের ঝুঁকি: এআই ব্যবহার করতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানর আধুনিক ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো দরকার, যা পিছিয়ে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আরও পিছিয়ে দেয়। 

ডেটা গোপনীয়তা: শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ফলে তাদের উপর নজরদারি বাড়ে, তথ্য চুরি বা তথ্যের অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে।

সমালোচনামূলক চিন্তার ঝুঁকি: সহজে এআই থেকে পাওয়া উত্তরের ফলে মেধা ও মনন বিকশিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। গভীর শিক্ষা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা-ভাবনার প্রবণতা কমিয়ে দেয়।

সুফল ও কুফল মোকাবেলার উপায়

ব্যক্তিগতকরণ বনাম অতিরিক্ত নির্ভরতা

ঝুঁকি: শিক্ষার্থীরা এআই-এর উত্তরের ওপর নির্ভর হয়ে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা হারাতে পারে।

সমাধান: অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষার সাথে এআই-কে যুক্ত করা। শিক্ষার্থীদেরকে প্রশ্ন করতে, বিশ্লেষণ করতে ও ব্যাখ্যা করতে শিক্ষকদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।

অন্তর্ভুক্তি বনাম ডিজিটাল বিভাজন

ঝুঁকি: পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এআই ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে বৈষম্য বাড়বে।

সমাধান: সরকার ও এনজিও ভর্তুকি দিয়ে ডিভাইস সরবরাহ ও কমিউনিটি লার্নিং হাব গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি খান একাডেমি, কোর্সএরা ডুয়োলিংগোর মতো অফলাইন-ভিত্তিক এআই অ্যাপও কার্যকর হতে পারে।

দক্ষতা বনাম মানবিক যোগাযোগ কমে যাওয়া

ঝুঁকি: শিক্ষক বা শিক্ষার্তীরা এআই-এর ওপর বেশি নির্ভরশীল হলে মানবিক দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে।

সমাধান: এ আই-কে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। শিক্ষকরা বেশি করে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে সহায়তা ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে সময় ব্যয় করবেন।

ডেটা বিশ্লেষণ বনাম গোপনীয়তা লঙ্ঘন

ঝুঁকি: তথ্যের অপব্যবহার।

সমাধান: তথ্য সুরক্ষা নীতি, তথ্য বেনামীকরণ এবং শিক্ষকদের ডিজিটাল নৈতিকতা প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

আত্ম-যোগাযোগ বা ইন্ট্রাপারসোনাল কমিউনিকেশন: সুফল ও কুফল

আত্ম-যোগাযোগ বা নিজের সাথে আলাপ-আলোচনা, চিন্তা-ভাবনা, মনকে বোঝা আসলেই শিক্ষা ও প্রযুক্তি বোঝার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সুফল: আত্ম-সচেতনতা মাধ্যমে অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। যেমন, এআই ভিত্তিক মূল্যায়নের পর আত্ম-পর্যালোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থী নিজের দুর্বলতা বা সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে।

কুফল: অতিরিক্ত আত্ম-আলাপ অনেক সময় উদ্বেগ বা আত্ম-সন্দেহ সৃষ্টি করে, বিশেষত যখন এআই তুলনা করে দুর্বলতা দেখিয়ে দেয়।

আত্ম-যোগাযোগের সুফল ও কুফল মোকাবেলার উপায়

আত্ম-সচেতনতা বনাম আত্ম-সন্দেহ

ঝুঁকি: অতিরিক্ত চিন্তা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।

সমাধান: ধ্যান, ইতিবাচক আত্ম-কথন, জার্নাল লেখা, ভিডিও স্টোরি তৈরি করা প্রভৃতি চর্চা করা।

প্রেরণা বনাম চাপ

ঝুঁকি: আত্মোন্নয়নের অতিরিক্ত চাপে মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে।

সমাধান: আত্ম-সহমর্মিতা চর্চা করা, ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করা।

আত্ম-পর্যালোচনা বনাম একাকিত্ব

ঝুঁকি: অতিরিক্ত আত্ম-মনোযোগ শিক্ষার্থীকে অন্য যেকোন কিছু বা পারিপার্শিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে।

সমাধান: আত্ম-যোগাযোগের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব বা সহপাঠীদের সাথে দলীয় আলোচনা এবং প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

উন্নত স্তরে এআই ব্যবহারে প্রয়োজন ডিজিটাল সাক্ষরতা, সমালোচনামূলক চিন্তা, নৈতিক সচেতনতা ও সৃজনশীল অভিযোজন। আত্ম-যোগাযোগ এখানে মূল চাবিকাঠি—আত্ম-পর্যালোচনা কৌতূহল বাড়ায়, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ শৃঙ্খলা আনে, আর আত্ম-প্রেরণা শেখার আগ্রহ জাগায়। শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মশালা ও অনুশীলন, শিক্ষকদের জন্য ইন্টিগ্রেশন ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পাশাপাশি শিক্ষকরা এ আই ভিত্তিক পাঠ পরিকল্পনা ব্যবহারিকভাবে শিখে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করবে। আর অভিভাবকদের জন্য সচেতনতা যেমন তাদের সন্তানের মোবাইল ডিভাইস বা টিভি দেখার স্ক্রিন টাইম কতক্ষণ হবে, নৈতিক ব্যবহার বিষয়ক সচেতনতা, ডিজিটাল শৃঙ্ক্ষলা বিষয়ক সচেতনতা জরুরি। শিক্ষক এবং অভিভাবক- উভয়কেই গোপনীয়তা, সুরক্ষা ও পক্ষপাত বিষয়ে সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীরা কীভাবে এআই ব্যবহার করবে, তা নিজে জেনে পরবর্তীতে তা ব্যবহারে সন্তানদের সহায়তা করবে।  এই সমন্বিত দক্ষতাই এআই-কে উদ্ভাবন ও শিক্ষার হাতিয়ার করে তুলবে।

বিশ্বে বেশকিছু বাস্তব উদাহরণ রয়েছে, যেমন ফিনল্যান্ডে শিক্ষকরা এআই ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি পর্যালোচনা করেন। পাশাপাশি সমস্যা নিরূপণ ও সমাধানের জন্য দলীয় আলোচনার সুযোগ রেখেছেন। এতে করে দুই পদ্ধতির মিশেলে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল ও কর্মমুখী হয়ে উঠে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেয় চ্যাটবট। আবার তাদের মানসিক সংকট এবং পড়ালেখাজনিত জটিল সমস্যার সমাধান করেন বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিরা।

এদিকে চীনের স্মার্ট ক্লাসরুমে এ আই ক্যামেরা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নিরূপণ করে। যদিও প্রাইভেসি নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন উঠেছে; কিন্তু এ আই এর উন্নত ব্যবহার বাড়ছে। ভারতে বাইজু অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগতভাবে শিখতে পারে। তবে অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণের সমালোচনা রয়েছে। সিঙ্গাপুরে এ আই এর মাধ্যমে দূর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করা হয়, যাতে তাদের প্রতি আলাদা মনোযোগ দেওয়া যায়।  

মহান দার্শনিক এরিস্টটটল বলেছেন, নিজেকে জানা হলো, সকল জ্ঞানের সূচনা।

এআই এবং আত্ম-যোগাযোগ এক হয়ে হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষায় বিপ্লব আনতে পারে। প্রযুক্তি যতই অগ্রসর হোক, শিক্ষার্থীরা যেন আত্মসচেতন, প্রতিফলনশীল ও অনুপ্রাণিত থাকে, সেসব নিশ্চিত করে আত্ম-যোগাযোগ। এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কতটুকু স্মার্ট হবে, তার ওপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে না। নির্ভর করবে মানুষ নিজেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে মনোসংযোগ ঘটিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে এআই-কে কীভাবে কাজে লাগাতে পারছে-তার ওপর। 

লেখক: সাংবাদিক
 
বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন