বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

মানুষ বড় কাঁদছে...

মাঈনুদ্দীন দুলাল ৭ সেপ্টেম্বর , ২০২৫, ১৪:৩৫:৩৩

526
  • মানুষ বড় কাঁদছে...

“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,

মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।”

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই লাইনগুলো শুঁয়োপোকার মত মগজে হাঁটছে গত কয়েক দিন ধরে। বুকের ভেতর কিলবিল করছে আতংক আর উদ্বেগ। যেদিন শুনলাম এবং ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখলাম একদল উন্মত্ত মানুষ কবর থেকে তুলে একটি মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে।  নুরাল পাগলা নামের এই মানুষটি একটি দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। কারো কারো ব্যাপারটি পছন্দ ছিল না। তারই প্রতিক্রিয়ায় এই নিষ্ঠুর মব সন্ত্রাস।

আমরা জানি কলেরা, গুটি বসন্ত, প্লেগ,সোয়াইন ফ্লু,সাম্প্রতিক করোনা মহামারি জীবিত মানুষদের আক্রান্ত করে।

এসব মহামারিতে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছেন। এই গ্রহের অদম্য প্রাণী মানুষ আবার এসব মহামারিকে নিয়ন্ত্রণও করেছে। আরও চ্যালেঞ্জ আসবে। আমরা সেসব মোকাবেলা করব।

সম্প্রতি মব সন্ত্রাস নামের এক দানব মহামারীর মত এই জনপদে ছড়িয়েছে।  এই মব মৃত মানুষকেও আক্রমণ করল।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সোসাইটির হিসেবে মতে, গত জুন পর্যন্ত ৯ মাসে মব দানবের তাণ্ডবে ১৩১ জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন।

অতি সম্প্রতি মব সন্ত্রাস আরেকটি নিষ্ঠুর তাণ্ডব চালিয়েছে। শুক্রবার (৫ আগস্ট) জুমার নামাজের পর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার নুরাল পাগলের দরবারে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় নুরাল পাগলের ভক্তদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়। মব সন্ত্রাসীরা নুরাল পাগলার মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কে এনে তা আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলে।

এই ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয় ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এতে ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। এই ঘটনায় পুলিশ অবশ্য মামলা করেছে। ঘটনাটি জানার পর বেদনাহত ও ভীত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

নুরাল পাগলার লাশ পোড়ানোর এ বর্বর ঘটনাকে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি  নিন্দা জানাচ্ছেন ধর্মীয় বয়ান কারীরাও। আলোচিত ইসলামী বক্তা মুফতী গিয়াস উদ্দিন তাহেরী একটি ইসলামিক মাহফিলে নুরাল পাগলার লাশ পোড়ানো নিয়ে কথা বলেছেন।

তাহেরী বলেন, ‘আমি দেখেছি, নুরাল পাগলা নামে একজন মানুষ মারা গেছে। যদি তার জীবনে অন্যায় করে থাকে, তার জীবনে যদি শিরক করে থাকে, তার জীবনে যদি ভণ্ডামি করে থাকে, তার জীবনে যদি কুফরি করে থাকে, সে যদি একদিন করে থাকে, একমাস করে থাকে, আপনি একজন মুসলমান হিসেবে দরকার ছিল বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা করে তাকে গ্রেপ্তার করানো।

কিন্তু সেই নুরা পাগলা যখন মারা গেল, কবরের ভেতরে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে কবর খুঁড়ে তার লাশটাকে বের করলেন। বের করার পর তার লাশকে নিয়ে উল্লাস করতে করতে ‘আল্লাহু আকবর’ ‘নারায়ে তাকবীর’স্লোগান দিয়ে দিয়ে আপনারা তার লাশটাকে পুড়িয়ে দিলেন।

এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটল উল্লেখ করে তাহেরী বলেন, ‘এখানে যারা আছেন ৫০ বছরের মানুষ আছে, ৬০ বছরের মানুষ আছে, স্বাধীনতার আগে পরের মানুষ আছে, আপনারা কেউ কোনোদিন দেখেছেন, কবর থেকে লাশ তুলে, মুসলমানের লাশ তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে? এমন ইতিহাস কি বাংলাদেশে হয়েছে? আমরা কি বাংলাদেশ দেখছি, আমরা কি দেখছি?’

অপরাধ বিশেষজ্ঞ  ড. তৌহিদুল হক একটি দৈনিকে এ বিষয়ে বলেন, ‘মব বন্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, সেই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে না। মব নিয়ে সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জারি করছে, কিন্তু যারা মব সন্ত্রাস তৈরি করছে তারা এগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। মব সন্ত্রাসকে এই মুহূর্তে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে মবের ইন্ধনদাতা এবং নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দিয়ে তাদের  গ্রেপ্তার করা উচিত। আর রাজনৈতিক পরিচয়ে যেসব মব তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দলের পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে এটি বন্ধ করা সম্ভব।’

 এ ঘটনা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় নিয়ে যাবে? কি এক নিষ্ঠুর ও অমানবিক সমাজ আমরা তৈরি করছি।  ভাবলেই গা শিহরে ওঠে। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গাও নেই।

নামতে নামতে খাদের এত তলানীতে যে,আর আমাদের নামার সামান্য জায়গাটুকুও নেই।

এই জনপদের মানুষ এখন বড় অসহায়।

নিউজজি/নাসি

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন