বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমে ২৫ বছর হারালাম সময়ের মূল্য

খন্দকার মোহাম্মদ আলী বাবু ১ সেপ্টেম্বর , ২০২৫, ১৬:৪৮:০১

311
  • জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমে ২৫ বছর হারালাম সময়ের মূল্য

সিরাজগঞ্জ: সম্প্রতি নিজের জীবনের অতিবাহিত সময় নিয়ে নিরবে ভাবছিলাম—গণমাধ্যমে পেশাদারত্ব নিয়ে ২৫ বছর কাজ করার পর আমি খন্দকার মোহাম্মদ আলী কী পেলাম? দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে রাত–দিন নিজের জীবনের দিকে খেয়াল না করে এলাকার মানুষের ন্যায্য অধিকারের জন্য কাজ করেছি। অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে আমার হাতের কলম। পত্রিকার পাতায় এবং ক্যামেরার ভিডিও চিত্রে ধারণ করা ফুটেজ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে নানা ঘটনার, যা গণমানুষের কল্যাণে এসেছে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ হয়েছে সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে।

তবে এই পেশায় কাজ করা অত্যন্ত দুরূহ। প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি। আমার মতো আরও অনেকে একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করলেও পার্থক্য শুধু জীবিকা নিয়ে। জানি না, কে কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। এ পেশায় থেকে আমার দারিদ্র্যতা, ব্যক্তিত্ব, সততা সব ম্লান হয়ে যায়—যখন পরিবারের অনাহারে থাকা ছোট্ট শিশুটির মুখের দিকে তাকাই। একরাশ কষ্ট নিয়ে কাজ শেষে ঘরে ফেরার পর স্ত্রী–সন্তানের কাছে নির্বাক হয়ে যাই। বলতে পারি না, আমার কর্মের পারিশ্রমিককে দেবে! হতবাক হয়ে ভাবি—এই শ্রমের মূল্য মানব রচিত বিবেকের সংবিধানে নেই। আছে শুধু প্রতিনিয়ত জীবন বিপন্ন হওয়ার কল্পকাহিনী আর ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতার তাণ্ডব।

বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম কর্মীরা হত্যা, গুম, খুন ও নাশকতার শিকার হচ্ছেন। অথচ গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হলেও গণমাধ্যম কর্মীরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পান না। দেশের সাধারণ মানুষ ন্যূনতম যে সুবিধাগুলো ভোগ করে, একজন সাংবাদিক তাও পান না। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান থেকেও বঞ্চিত হন নানা অবজ্ঞা ও অবহেলায়।

একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ বা চাকরিজীবীর জীবিকার পথ যেমন সুগম, তেমনভাবে একজন মফস্বল সাংবাদিকের জীবিকার পথ রুদ্ধ থাকে নীতিনৈতিকতার বেড়াজালে। সাংবাদিক ইচ্ছা করলেই অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে পারেন না, কারণ তার কলমই তাকে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ করে ফেলে। অন্যায় আড়াল করতে গিয়ে নিজের কলমে লিখে ফেলবেন বিবেকের পাণ্ডুলিপি, যা আগামী প্রজন্মের কাছে কলঙ্ক হয়ে থাকবে।

এখন দেখা যায়—রাজনীতির ছত্রছায়ায় কিছু ব্যক্তি সাংবাদিক পরিচয়ে সুবিধা নিচ্ছে। প্রকৃত সাংবাদিকরা সেখানে অবহেলিত। অপরাধীরাই সাংবাদিকতার মুখোশ পরে ঘুরছে, আর যোগ্য সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।

সময় এসেছে—গণমাধ্যমকে তার আসল দায়িত্বে ফিরে আসতে হবে। রাজনীতি ও গণমাধ্যমের সৎ ব্যক্তিত্বরা মিলে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুক। তাহলেই সমাজে শৃঙ্খলা ফিরবে, মানব সভ্যতার লক্ষ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।

আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি হতে চাইনি সংবাদকর্মী। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিবাদ লেখা আমাকে এই পেশায় টেনে এনেছে। গত ২৫ বছর অন্যায়, দুর্নীতি আর অনৈতিক ঘটনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছি। অথচ এই দীর্ঘ সময় শেষে আমি কী পেলাম? পরিবার হারালাম, সময় হারালাম, জীবিকা হারালাম। বিবেকের কাছে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

আজ যারা সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—তাদের অনেকে নীতিহীন, কেউ রাজনৈতিক দলের হয়ে, কেউ আবার অপরাধ জগতকে আড়াল করে সাংবাদিকতার পরিচয় নিচ্ছে। সহজেই তারা গণমাধ্যমে প্রবেশ করছে টাকার বিনিময়ে। নেই ভেরিফিকেশন, নেই সামাজিক দায়বদ্ধতা। মাদক ব্যবসায়ী, হত্যা মামলার আসামি, জাল টাকার হোতা—এমনকি অসৎ রাজনীতিবিদ ও চাকরিচ্যুত অপরাধীরাও সাংবাদিক পরিচয় পাচ্ছে। এভাবে গণমাধ্যমে প্রবীণদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে গণমাধ্যম এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে, যা সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। সময় এসেছে সংস্কার করার। প্রশ্ন রয়ে গেছে—আমার মতো মফস্বল সাংবাদিকের জীবনের ২৫ বছরের শ্রম, সততা, কষ্টের মূল্য কে দেবে? জনগণের কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগী সাংবাদিকদের মূল্যায়ন কে করবে?

আমি কেবল জনগণের কাছেই আবেদন জানালাম—মৃত্যুর পূর্বে যেন অন্তত একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি।

নিউজজি/নাসি

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন