বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

ডাকসু নির্বাচন: প্রগতিশীল ঐতিহ্য রক্ষার পরীক্ষা

এজাজ ইউসুফী ২৬ আগস্ট , ২০২৫, ১৯:০২:৫৯

464
  • সংগৃহীত

১. বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে ২০২৫ সালের নির্বাচন এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান, যা শুধু ক্ষমতার ভারসাম্য নয়, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকনির্দেশক শক্তিকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান তরুণ প্রজন্মের রক্ত ও আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে, ডাকসু নির্বাচন তারই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা।

২. দীর্ঘ সময় ডাকসু কার্যত অচল ছিল। কখনও কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির প্রভাবে, কখনও প্রশাসনিক কালক্ষেপণে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে এটি ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রধান ক্ষেত্র ছিল। অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রজন্ম নতুন করে যে গণতান্ত্রিক চেতনা ও সাংগঠনিক সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, ডাকসুর মাধ্যমে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে, এ নির্বাচন আর কেবল ক্যাম্পাসের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আজ জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন সূচনা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ছাত্রসমাজ কি তাদের আন্দোলনের উত্তরাধিকারকে রক্ষা করে তা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারবে, নাকি আবারও দলীয় আধিপত্যের পুরনো বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে ডাকসুর ব্যালটের ওপর।

৩. ডাকসুর অস্তিত্বকে বোঝার জন্য এর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার স্মরণ করা অপরিহার্য।  ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—প্রত্যেকটিতে ডাকসুর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ডাকসুর নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ডাকসু কেবল প্রতীকী ভূমিকা নয়, কার্যকর নেতৃত্বও দিয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে ডাকসুর ভিপি, জিএস কিংবা সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

৪. বাংলাদেশে প্রগতিশীলতা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তচিন্তার যে ধারা আজও টিকে আছে, তার শিকড় ডাকসুর ইতিহাসে নিহিত আছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের নেতৃত্বে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ" (Dhaka University Central Students' Union) সংক্ষেপে "ডাকসু" রূপে কাজ শুরু করে। দীর্ঘ এক শতাব্দীর প্রায়শই অগ্নিঝরা ইতিহাসে ডাকসু হয়ে ওঠেছে জাতীয় সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নির্ভরযোগ্য নেতৃত্বের ক্ষেত্র। এজন্যই একে “বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ” বলা হয়।

৫. ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন নানা কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি আবারও নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কারণে। ওই আন্দোলনে প্রমাণিত হয়েছে যে, তরুণ প্রজন্ম আজও ন্যায়, অধিকার ও গণতান্ত্রিক স্বপ্নের জন্য সোচ্চার হতে প্রস্তুত। ফলে, এবারের নির্বাচন শুধু একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়; এটি হয়ে উঠেছে জাতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার প্রতীকী লড়াই।

দ্বিতীয়ত, ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রাজনীতিতে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলির শক্ত দুর্গ হিসেবে হিসেবে পরিচিত এই ক্যাম্পাসে এবার ভিন্ন মাত্রায় সক্রিয় হয়েছে ধর্মীয় ও দক্ষিণপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো।

রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনামলে নিষিদ্ধ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে সরাসরি রাজনীতি করার সুযোগ না পেলেও ভিন্ন কৌশল নেয়। তারা ছাত্রলীগের ভেতরে অনুপ্রবেশ করে এবং হলগুলোতে গোপনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এতে করে গুপ্ত ছাত্রলীগের নামে হলেও শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান ছিল।

জুলাই ২০২৪-এর ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হলে ওই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ছাত্রলীগের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা শিবিরকর্মীরা প্রকাশ্যে সংগঠন পরিচালনা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটাই প্রথমবার যে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেল।

অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের কারণে এখনো ক্যাম্পাসে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষত আবাসিক হলগুলোতে এখনও প্রবেশাধিকার না পাওয়ায় তারা কার্যত রাজনীতির মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন।

বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে আবাসিক হলগুলোর নিয়ন্ত্রণই হবে মূল নির্ধারক। ছাত্রলীগের অনুপস্থিতি ও ছাত্রদলের দুর্বলতা শিবিরকে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এবারের নির্বাচনে ছয়টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে কেবল শিবির-সমর্থিত প্যানেল ডানপন্থী মতাদর্শের, বাকিরা গণতান্ত্রিক ভাবধারার। তবে ভোট ভাগাভাগির কারণে শিবির-সমর্থিত প্যানেলের জয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্রচারণার কারণে এবারের ডাকসু নির্বাচন পূর্ববর্তী সব নির্বাচনের তুলনায় বেশি প্রচারাভিযানকেন্দ্রিক হয়ে ওঠছে। একদিকে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো ইতিহাস, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল চেতনার পক্ষে আহ্বান জানাচ্ছে। অন্যদিকে, দক্ষিণপন্থীরা ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী বক্তব্য দিয়ে ভিন্নধর্মী এজেন্ডা সামনে আনছে।

৬. প্রশ্ন জাগছে—যদি ডানপন্থী প্যানেল ডাকসুর নির্বাচনে জয়লাভ করে, তবে এর পরিণতি কী হতে পারে?

ক. ডাকসু বরাবরই প্রগতিশীল ও মুক্তিকামী চিন্তার প্রতীক। দক্ষিণপন্থীদের জয় মানে হবে এই ইতিহাসের এক ধরনের অস্বীকৃতি। ফলে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক চেতনা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

খ. ডানপন্থী সংগঠনগুলো সাধারণত সমঝোতা নয়, বরং মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে ঝোঁকে। এতে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বাড়তে পারে, ক্যাম্পাসে সহিংসতা ও বিভাজন তীব্র হতে পারে।

গ. ডাকসুর নির্বাচিত নেতৃত্ব প্রায়শই জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখে। দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থান মানে জাতীয় রাজনীতিতেও ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার প্রবল প্রভাব পড়বে, যা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ঘ. বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণপন্থী উত্থান মানে আন্তর্জাতিক ডানপন্থী নেটওয়ার্কেরও প্রভাব বিস্তার। এটি বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

৭. এবারের ডাকসু নির্বাচন তাই শুধু একটি ছাত্র সংসদ গঠন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি প্রগতিশীল উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে, তবে জাতি নতুন আশার আলো পাবে। কিন্তু যদি দক্ষিণপন্থী গুপ্ত সংগঠনগুলো প্রভাব বিস্তার করে জয়লাভ করে, তবে তার অভিঘাত কেবল ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—পুরো জাতির জন্য তা অন্ধকার ভবিষ্যতের বার্তা বহন করবে।

ডাকসুর ব্যালট কেবল একটি ভোট নয়, এটি প্রজন্মের স্বপ্ন, স্বাধীনতার চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের অঙ্গীকার।

লেখক : সাংবাদিক
 
বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন