বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জুলাই ঘোষণাপত্র: নতুন পথ চলার প্রতিশ্রুতি না পুনরাবৃত্তির শঙ্কা?

মো. আবদুর রহিম ৫ আগস্ট , ২০২৫, ২১:০৯:১৪

3K
  • ছবি : নিউজজি

৫ আগস্ট ২০২৫ – এই তারিখটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এদিন জাতির সামনে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই ঘোষণাপত্রে গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক দুর্যোগ, শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের পূর্ণ বিবরণ যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখাও দেয়া হয়েছে।

ঘোষণাপত্রে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে শুরু করে একদলীয় বাকশাল, সামরিক শাসন, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, ১/১১-এর ষড়যন্ত্র, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন, ভোটাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গুম-খুন, অর্থনৈতিক লুণ্ঠনসহ প্রায় অর্ধশতকের ব্যর্থতা ও অন্যায়ের ধারাবাহিক বিবরণ উঠে এসেছে। ঘোষণাপত্রটি একটি রাজনৈতিক দল বা জোটের পক্ষ থেকে নয়, বরং ‘বাংলাদেশের জনগণের’ পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে— এমনটাই দাবি করা হয়েছে এতে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে: ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি কি সত্যিই জনগণের ঐক্য ও প্রত্যয়কে তুলে ধরছে, নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগনির্ভর একতরফা ব্যাখ্যা মাত্র?

রাজনৈতিক বাস্তবতা বনাম আদর্শিক উচ্চারণ

ঘোষণাপত্রটি স্পষ্টভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘মাফিয়া রাষ্ট্রের’ রূপকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ভাষাগত কঠোরতা একদিকে যেমন আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের প্রতিফলন, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতার সংকেতও বয়ে আনে।

এতদিনে দেখা গেছে, পূর্বতন শাসকের বিরুদ্ধে জনরোষ ও বিপ্লব যতই বাস্তব হোক না কেন, ক্ষমতায় আসার পর নতুন নেতৃত্বের মাঝেও একই ধরনের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। তাই এই ঘোষণাপত্র কেবল শাসক পরিবর্তনের দলিল না হয়ে শাসনের পদ্ধতি ও নৈতিকতার পরিবর্তনের অঙ্গীকার কিনা— সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সাংবিধানিক সংস্কারের আশা

ঘোষণাপত্রে ভবিষ্যৎ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংস্কারকৃত সংবিধান, বৈষম্যহীন সমাজ, সুশাসন, মানবাধিকার রক্ষা ও জলবায়ু-সহিষ্ণু উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক রূপরেখা। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় নিহতদের জাতীয় বীর ঘোষণা ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার এই ঘোষণাপত্রকে আরও মানবিক করেছে।

তবে, কেবল উচ্চারিত প্রতিশ্রুতি নয়, এগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি, সময়সূচি, আইনি কাঠামো এবং জবাবদিহিতা কেমন হবে— সেসব প্রশ্ন এখনো অনির্দিষ্ট।

নতুন শাসনব্যবস্থার প্রতি জাতির আস্থা গড়া জরুরি

এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জনগণের সেই আস্থা অর্জন করা, যা তারা বারবার হারিয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক আলোচনার আয়োজন, বিদ্বেষের জবাবে সংলাপের আহ্বান, এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন।

শুধু অতীতের ভুল তুলে ধরলে বা প্রতিপক্ষকে অপমান করলেই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টাবে না। বরং প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে নতুন এক নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা গড়ে তোলা— যেন আগামীর প্রজন্ম বুঝতে পারে, জুলাই ঘোষণাপত্র ছিল কেবল এক বিপ্লবের শেষ নয়, বরং এক নতুন বাস্তবতার সূচনা।

বাংলাদেশ এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়, তাহলে এই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ সত্যিই হতে পারে একটি নতুন যুগের পথনির্দেশ। কিন্তু যদি এটি হয়ে ওঠে কেবল আরেকটি রাজনৈতিক দলিল, তাহলে জনগণের হতাশা আরও গভীর হবে— যা ভবিষ্যতে আবারও এক অভ্যুত্থানের জন্ম দিতে পারে।

লেখক : সমাজকর্মী ও সাংবাদিক
 
বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

নিউজজি/এস দত্ত

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন