বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জলবায়ু পরিবর্তন ও নারী: এক সংকটের নীরব সাক্ষ্য

মোস্তফা কামাল ৫ আগস্ট , ২০২৫, ০০:১৭:২৭

362
  • জলবায়ু পরিবর্তন ও নারী: এক সংকটের নীরব সাক্ষ্য

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন আজ সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকটগুলোর একটি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, উলটপালট হয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

কিন্তু এই বিপর্যয়ের প্রভাব যে সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না, সে বাস্তবতাটা আমরা কতটা উপলব্ধি করি? বিশেষ করে নারীরা-জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়ায় আজ সবচেয়ে বড় অনিরাপদ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা শিল্পায়নের প্রতিযোগিতা, উন্নয়নের নামে বন উজাড়, নদী খননহীনতা, কার্বন নিঃসরণে লাগামহীনতা-সব মিলিয়ে এই বাসযোগ্য পৃথিবীকে আমরা নিজের হাতে প্রতিনিয়ত অনাবাসযোগ্য করে তুলছি। আর এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার লড়াইটা নারীর জন্য বহু গুণ বেশি কঠিন হয়ে উঠছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীর উপর সরাসরি প্রভাব

নারীর জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। তারা পানির জন্য হাঁটেন, খাবার সংগ্রহ করেন, ঘরের ভেতরে ও বাইরে সংসারের ভার সামলান। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ে-বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো-তখন তাদের ওপরই পড়ে সবচেয়ে বড় বোঝাটা।

উপকূলীয় অঞ্চলে ঘরহারা মানুষদের আশ্রয় নিতে হয় সাইক্লোন শেল্টারে। কিন্তু সেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী-বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। নেই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর শৌচাগার বা গোসলের ব্যবস্থা। দিনে স্নান বা প্রয়োজনীয় কাজ করা তো দূরের কথা, রাতের আঁধারে নিজেদের গোপনীয়তা রক্ষা করেই তারা চরম অস্বস্তির মধ্যে দিন পার করেন। কন্যা শিশুদের নিরাপত্তা নিয়েও থাকে বিপুল শঙ্কা। যৌন হয়রানি, অপমান আর অবহেলা-সব মিলিয়ে এই নারীদের বাস্তবতা শুধু কঠিন নয়, অনেক সময় অবর্ণনীয়। 

লবণাক্ততা ও নারীস্বাস্থ্যের অজানা বিপর্যয়

খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট-এইসব উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে নারীরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছেন লবণাক্ত পানি। এই পানি তাদের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জরায়ুতে নানা ধরনের সংক্রমণ, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, উচ্চ রক্তচাপ, প্রজনন অক্ষমতা, এমনকি শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে।

এক জরিপ বলছে, এসব অঞ্চলে গর্ভপাত ও অপরিণত শিশু জন্মের হার বেড়েছে লবণাক্ত পানির কারণে। অথচ এই সমস্যাগুলোর পেছনে দায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বৈশ্বিক সংকট, যা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় নারীর কোনো হাত নেই। তবু ভুক্তভোগী হয়ে প্রতিনিয়ত তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

হাওর অঞ্চলের নারীরা আরও এক ধাপে পিছিয়ে

উপকূলের মতো হাওর অঞ্চলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভয়াবহ। দীর্ঘ মেয়াদে বন্যা, অকাল বৃষ্টি কিংবা খরায় ফসল নষ্ট হলে সংসারের দায় গিয়ে পড়ে নারীর কাঁধে। তারা সন্তানদের না খাইয়ে নিজে না খেয়ে থাকেন, সবার আগে নিজের প্রয়োজন কাটছাঁট করেন। কিন্তু এসব তথ্য খুব একটা আলোচনায় আসে না।

বিশেষ করে ১২ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেনোপজ, জরায়ুতে সিস্ট, অনিয়মিত ঋতুচক্র, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যায়। অথচ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত পরামর্শ বা ওষুধ পাওয়া যায় না। পরিবার ও সমাজের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই চুপচাপ ভুগতে থাকেন।

নারী ও শিশুর জন্য প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল পরিকল্পনা

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যদি নারী-বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে, তবে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী ও শিশুর উপযোগী করে গড়ে তোলা, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো, স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত নারী স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা-এসবই হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতো সংগঠন ইতোমধ্যেই পরিবেশ উপ-পরিষদ গঠন করে নারীর জলবায়ু-ঝুঁকিজনিত অধিকার রক্ষায় কাজ শুরু করেছে, যা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।

কিশোরী-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য শিক্ষার দরকার

শিশু ও কিশোরীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো সময়ের দাবি। কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল ও কলেজগুলোতে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা চালু করতে হবে। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলাদা সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালু করা দরকার।

আরও জরুরি হলো, নারীর জীবিকা নিশ্চিত করা। উপকূল ও হাওর অঞ্চলে নারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারলে, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা দুটোই একসঙ্গে আসবে। এতে নারীর আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়বে, তেমনি তার অধিকার রক্ষায়ও একটি বড় ধাপ এগোনো সম্ভব হবে। 

শেষ কথা: নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু নীতিতে বদল দরকার

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু একটি বৈজ্ঞানিক বা পরিবেশগত সংকট নয়, এটি একটি সামাজিক এবং জেন্ডার ইস্যু। নারীকে এই সংকটের কেন্দ্রে এনে যদি আমরা সমাধান খুঁজি, তাহলে সেটা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই।

আজ প্রয়োজন এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা নারী, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করবে।

কেননা, প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচে-আর মানুষ মানেই শুধু পুরুষ নয়, মানুষ মানেই নারী, কিশোরী, শিশু, বৃদ্ধ-সবার সম্মিলিত অস্তিত্ব। এখনই সময়, নারীর কণ্ঠকে জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার। কারণ তারাই প্রকৃতির সবচেয়ে নীরব, অথচ সবচেয়ে বলিষ্ঠ সাক্ষী।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন