মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ কার্তিক ১৪৩২ , ২০ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জলবায়ু উদ্বাস্তু: বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকট ও বাস্তবতা

সুমন মোস্তফা ২৬ জুলাই , ২০২৫, ০৭:৩৬:১৫

332
  • জলবায়ু উদ্বাস্তু: বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকট ও বাস্তবতা

জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর কোনো ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, এটি এখনকার বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বাস্তবতা সবচেয়ে তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে। 

বিশেষ করে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফের মতো এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

উপকূল থেকে পাহাড়ে বাস্তুচ্যুতি

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, মাটি ক্ষয়, লবণাক্ততা ও প্যারাবন ধ্বংসের মতো কারণে মানুষ তাদের বসতভিটা হারাচ্ছে। এই ঘরছাড়া মানুষেরা আশ্রয় নিচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা শহরতলির বস্তিতে।

ফলে একদিকে যেমন তারা তাদের পরিচিত পরিবেশ হারাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের জীবনধারণও হয়ে উঠছে আরও অনিশ্চিত ও সংকটময়।

মৎস্য ও কৃষিভিত্তিক জীবিকায় ভাঙন 

এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই মাছ ধরা, নোনা ধানের চাষ কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মাছের ঘের ও জাল নষ্ট হচ্ছে, নৌকা ডুবে যাচ্ছে। ফলে জীবিকা হারিয়ে মানুষ বাধ্য হচ্ছে অন্য পেশায় যেতে বা অনিশ্চিত গন্তব্যে রওনা দিতে।

নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের মধ্যে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। বসতভিটা হারিয়ে যেসব নারী নতুন এলাকায় আশ্রয় নেন, তাদের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে-বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে তারা চরম সংকটে পড়েন। শিশুরা স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এবং অনেক সময় শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে।

দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতির পরিসংখ্যান

নরওয়েভিত্তিক সংস্থা আইডিএমসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে দুর্যোগজনিত কারণে প্রায় ২৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।

মূলত ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাই এই বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ। এই বাস্তুচ্যুতির পর মানুষদের সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দাঁড়ায় আবাসন, বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ বিদ্যুৎ।

কাঠামোগত দুর্বলতা ও দুর্নীতি

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়ায় প্যারাবন ধ্বংসের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিপুল ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত স্থায়িত্ব আসেনি।

সুপার ডাইক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বহু বছর ধরে শোনা গেলেও এখনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এই অব্যবস্থাপনা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।

বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার

জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে দায়ী প্রধানত ধনী দেশগুলোর অতিভোগ, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও শিল্পায়নের অপব্যবহার। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশসহ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো।

প্যারিস চুক্তি, কোপেনহেগেন, দুবাই, বাকু ইত্যাদি শহরে প্রতিবছর সম্মেলন হয় ঠিকই, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ধনী দেশগুলো এখনও জলবায়ু তহবিলে প্রতিশ্রুত অর্থ যথাযথভাবে প্রদান করছে না, যা আমাদের মতো দেশের জন্য ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করছে।

আমাদের করণীয়

বাংলাদেশের জন্য এই সংকট মোকাবিলায় ত্বরিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

টেকসই বেড়িবাঁধ ও সুপার ডাইক: উপকূল রক্ষায় স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।

জীবিকার বিকল্প সৃষ্টি: উদ্বাস্তুদের জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

নারী ও শিশু সুরক্ষা: আশ্রয়স্থলে নারীর নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার নিশ্চয়তা দরকার।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লবিং: বিশ্বদরবারে আমাদের দাবি তুলে ধরতে হবে আরও জোরালোভাবে।

দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ: জলবায়ু অভিযোজনকে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে।

পরিশেষে

জলবায়ু উদ্বাস্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। এই সংকট যদি এখনই আমলে না নেওয়া হয়, তবে আগামী দশকে এর পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।

আমরা যদি এখনই প্রস্তুতি না নেই, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে ক্ষুধার্ত, গৃহহীন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে জর্জরিত একটি জাতি। এখনই সময়—পরিবেশ ও মানুষের সুরক্ষায় একসঙ্গে কাজ করার। কারণ একজনও যদি সুরক্ষিত না থাকে, তবে আমরা কেউই সুরক্ষিত নই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ইমেইল: sumonmostufa13@gmail.com

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন