বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: স্বাস্থ্য ও নারী কর্মসংস্থান হুমকির মুখে

সুমন মোস্তফা ২৪ জুলাই , ২০২৫, ০০:২৫:৩০

416
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: স্বাস্থ্য ও নারী কর্মসংস্থান হুমকির মুখে

বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের এক অভূতপূর্ব চাপে দাঁড়িয়ে আছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, চরম আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-সব কিছুই এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। কিন্তু এই পরিবর্তনের প্রভাব সমানভাবে পড়ে না সবার ওপর। নারী ও শিশুদের উপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই প্রভাব আরও সুস্পষ্ট।

নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা নারীদেহে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো:

১. প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় প্রবণতা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির সংকট দেখা দেয়, যা পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে অনেক নারী ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন (UTI), গাইনোকলজিকাল ইনফেকশন এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হন।

২. মশাবাহিত রোগে নারীরা বেশি ঝুঁকিতে

বন্যা ও জলাবদ্ধতার ফলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি রোগ বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পরিবারের যত্ন নিতে গিয়ে আক্রান্ত সদস্যদের পাশে বেশি সময় থাকেন এবং তারাও সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েন।

৩. অপুষ্টি ও খাদ্য ঘাটতি

খরার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যায়, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে নারীদের খাদ্য গ্রহণে। অনেক পরিবারে নারী ও শিশুরা শেষ পর্যন্ত খায় বা কম খায়। এর ফলে অপুষ্টি, আয়রন ঘাটতি, রক্তাল্পতা ইত্যাদি দেখা যায়।

নারী কর্মসংস্থানে জলবায়ুর ছায়া

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি, পোশাক, খুচরা ব্যবসা ও হস্তশিল্পসহ অনেক খাতে কর্মরত নারীরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন বা আয় হ্রাস পাচ্ছে।

১. কৃষিনির্ভর নারীদের আয় কমছে

বাংলাদেশে বহু নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত। খরা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ফসল বিনষ্ট হলে তাদের কাজও হারাতে হয়। অনেক নারী মৌসুমি কৃষিকাজে যুক্ত থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জীবিকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে।

২. গ্রামীণ হস্তশিল্প ও ছোট ব্যবসায় বিপর্যয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পরিবহন ব্যবস্থা, কাঁচামালের জোগান ও পণ্য বিপণন বিঘ্নিত হয়। হস্তশিল্পে যুক্ত অনেক নারী এই প্রভাবের শিকার হন।

৩. পোশাকশিল্পেও প্রভাব

যদিও পোশাকশিল্প সরাসরি জলবায়ুর প্রভাবে নয়, তবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ায় এবং বিদ্যুৎ/জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়, যার ফলে নারী শ্রমিকদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে।

জলবায়ু অভিবাসন ও নারী নিরাপত্তা

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় প্রভাব হলো অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসন। যখন পরিবার গৃহহীন হয় বা কৃষিজমি হারায়, তখন তারা শহরের বস্তিগুলোতে আশ্রয় নেয়। এসব এলাকায় নারীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে।

যৌন হয়রানি, মানবপাচার ও বাল্যবিবাহের হার বাড়ে।

শহরে নারীশ্রমের ওপর চাহিদা কম থাকলে তারা অনানুষ্ঠানিক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত হন (যেমন: গৃহকর্ম, সড়ক পরিচ্ছন্নতা)।

সামাজিক ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে নারী নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে জলবায়ু অভিযোজন বা টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতেও নারীর চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে প্রতিফলিত হয় না।

অনেক নারী জানতে পারেন না কীভাবে সরকারি সাহায্য, রিলিফ বা প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের যুক্ত না করায় অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয় বা স্থায়ী সুফল দেয় না।

সমাধান কী?

এই সংকট মোকাবেলায় চাই সুপরিকল্পিত ও নারীবান্ধব জলবায়ু অভিযোজন কৌশল।

১. নারীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে মোবাইল হেলথ ইউনিট, প্রজনন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও স্যানিটেশন সুবিধা বাড়াতে হবে।

২. কর্মসংস্থানের বিকল্প তৈরি

নারীদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন (স্কিল ডেভেলপমেন্ট) প্রশিক্ষণ, টেকসই কৃষি ও হস্তশিল্পভিত্তিক উদ্যোগে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।

৩. নারী নেতৃত্বে জলবায়ু প্রকল্প

স্থানীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারী ইউপি সদস্য, স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধি বা কমিউনিটি নেত্রীদের মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।

৪. সচেতনতা ও শিক্ষা

জলবায়ু বিষয়ে নারী ও কিশোরীদের সচেতন করতে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার ও রেডিও/টিভিতে প্রচারণা চালানো দরকার।

পরিশেষে

জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু পরিবেশগত ইস্যু নয়, এটি মানবিক সংকটের রূপ নিচ্ছে। নারীদের স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান এই সংকটের অন্যতম ভুক্তভোগী খাত। অথচ নারীরাই হতে পারেন পরিবেশ রক্ষার যোদ্ধা, যদি সুযোগ, নিরাপত্তা ও সম্মান দেওয়া হয়। তাই ভবিষ্যতের উন্নয়ন কৌশলে জলবায়ু এবং লিঙ্গ-উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন