বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

“অষ্টম দশকের অভিশাপ” — যে আতঙ্কে কাঁপছে ইসরায়েল

মো. আবদুর রহিম ১৬ এপ্রিল , ২০২৫, ১৮:২২:১৭

3K
  • “অষ্টম দশকের অভিশাপ” — যে আতঙ্কে কাঁপছে ইসরায়েল

বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার ও ক্ষমতাধর মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে চলা একটি রাষ্ট্র যখন অসংযত হয়ে ওঠে, তখন বোঝা যায়—তার ভেতরেই কোথাও গভীর দুর্বলতা লুকিয়ে আছে। ইসরায়েলের বর্তমান আচরণকে ঘিরে এমনই প্রশ্ন জেগেছে বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে গাজায় চলমান নিষ্ঠুর অভিযানের প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েল নিজেই তার অস্তিত্ব নিয়ে গভীর আশঙ্কায় ভুগছে।

সাম্প্রতিক এক ঘটনায় ইসরায়েলের এক মন্ত্রী গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলার আহ্বান জানান। এই উগ্র ও অমানবিক বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়—ইসরায়েল সরকার ও নেতৃত্বের মানসিক কাঠামোয় এক ধরনের আতঙ্ক ঘনিয়ে এসেছে। আর সেই আতঙ্কের নাম—“অষ্টম দশকের অভিশাপ”।

কী এই অভিশাপ?

ইহুদিদের ধর্মীয় আইন ও নীতিমালা ভিত্তিক গ্রন্থ তালমুদ-এ রয়েছে একটি পুরনো ভবিষ্যদ্বাণী: “কোনো ইহুদি রাষ্ট্র ৮০ বছরের বেশি টিকে না। পতন ঘটে নিজেরাই নিজেদের বিভাজনের কারণে।” ইতিহাসও এই ভবিষ্যদ্বাণীর সমর্থন দেয়। কিং ডেভিডের রাজত্ব বা হাসমোনিয়ান যুগ—কোনোটাই ৮০ বছরের গণ্ডি টপকাতে পারেনি। আর আজকের আধুনিক ইসরায়েলের জন্ম ১৯৪৮ সালে। অর্থাৎ ২০২৮ সালে তাদের ৮০ বছর পূর্ণ হবে—আর এই সংখ্যাটিকে ঘিরেই বাড়ছে উদ্বেগ।

রাজনীতিকরাও বলছেন ‘অভিশাপের কথা

ইহুদি ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী বহু ইসরায়েলি নাগরিক এই ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি কেবল ধর্মীয় লোককাহিনি নয়, বরং ইসরায়েলের রাজনীতিকদের কথায়ও এই ভবিষ্যদ্বাণীর ছায়া স্পষ্ট। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ও রিউভেন রিভলিন বহুবার তাদের বক্তব্যে বলেছেন—ইসরায়েলি সমাজ ভয়ানক বিভক্ত। সেক্যুলার বনাম ধর্মীয়, বাম বনাম ডান, জায়নবাদী বনাম অ্যান্টি-জায়নবাদী—এই বিভাজন রাজনীতিকে করছে দুর্বল, সমাজকে করছে ক্ষতবিক্ষত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও অতীতে বলেছেন, ইসরায়েলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে, না হলে হাসমোনিয়ান রাজত্বের মতো এরাও টিকে থাকবে না। এমনকি ২০২০ সালে নির্বাচনী প্রচারে নাফতালি বেনেট বলেছিলেন, “আমার সরকারই পারবে অষ্টম দশকের অভিশাপের হাত থেকে ইসরায়েলকে বাঁচাতে।”

বিভক্তি ও অবিশ্বাসের বাস্তবতা

মিডল ইস্ট মনিটর ও লেবাননের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েলের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস চরমে। হেরেদি ইহুদিরা মনে করেন জায়নবাদীরা তাওরাতবিরোধী। অপরদিকে জায়নবাদীরা হেরেদিদের দেখছেন আরবদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে। এই আদর্শিক দ্বন্দ্ব শুধু ধর্ম নয়, জাতীয়তার প্রশ্নেও ইসরায়েলি সমাজকে বিভক্ত করছে।

ভবিষ্যৎ কি অনিবার্য?

ইতিহাসবেত্তারা বলছেন, ৮০ বছরে একেকটি রাষ্ট্র তৃতীয় প্রজন্মে পৌঁছায়—যেখানে আদর্শগত দ্বন্দ্ব, প্রত্যাশা ও অভিজ্ঞতার ফারাক ঘনীভূত হয়। সেই সংঘাত কখনো কখনো ভাঙনের পথ তৈরি করে। তবে অনেকে এটিকে ধর্মীয় কুসংস্কার বলেও উড়িয়ে দিচ্ছেন।

হামাসের দৃষ্টিভঙ্গি

হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন ২৫ বছর আগেই বলেছিলেন, ইসরায়েলের পতনের সময়কাল শুরু হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সংঘাতে মুখপাত্র আবু উবায়দা বলেন, “এই যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ—ইসরায়েলের সময় শেষ।”

অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার নেপথ্যে আতঙ্ক?

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল গাজার বিরুদ্ধে যে মাত্রায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে, তা শুধু প্রতিশোধ নয়—বরং নিজ অস্তিত্ব রক্ষার এক আতঙ্কজনিত প্রতিক্রিয়া। কারণ, যে রাষ্ট্র ভবিষ্যতের পতনের ভয় বয়ে বেড়ায়, সে চায় সব ভয়কে আগেই মুছে ফেলতে |

ইসরায়েল টিকবে না—এমন ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে কি না, সময়ই বলবে। তবে ইসরায়েল নিজেই যদি সেই আতঙ্কে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে, তাহলে তালমুদের অভিশাপ হয়তো এক অর্থে সত্যই হয়ে উঠবে।

লেখক: সমাজকর্মী ও সাংবাদিক

বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন