বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতায় কমাতে হবে ‘শব্দদূষণ’

ইউসুফ আলী বাচ্চু ১৯ মে , ২০২৪, ১৬:১৫:১৩

842
  • আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতায় কমাতে হবে ‘শব্দদূষণ’

রাজধানীসহ ও মফস্বল শহরগুলোতেও অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে শব্দদূষণ। এর ফলে বৃদ্ধ ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শব্দদূষণ জনিত না না শারিরিক সমস্যায়। দিনে দিনে বধিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি জাতি। যানবাহনে হাড্রোলিক হর্ন বাজনোর নিয়ম না থাকলেও মোটর সাইকেল থেকে সব ধরনের যানবাহনে এই হর্ন বাজানো হয়। প্রায় সময় দেখা যায় অ্যামবুলেন্সে রোগী না থাকলেও উচ্চশব্দে হর্ণ বাজাতে থাকে। ফাঁকা রাস্তায় অপ্রয়োজনেও হর্ন বাজানো যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এছাড়া উঠতি বয়সি ধনীর দুলালরা তো যা মন চায় তাই করে প্রতিনিয়ত রাস্তায়। মোটর সাইকেলে আলাদা সাইলেন্সার লাগিয়ে মহল্লার রাস্তাগুলো কাঁপিয়ে তোলে। তাদের নিষেধ করলে উল্টো হেনস্থার শিকার হতে হয়।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কী আছে?

সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদ জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। এ অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকার শুধু টিকে থাকাকে বোঝায় না, বরং মানসম্মত জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এ থেকে বলা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি শব্দদূষণের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ বা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিগ্রস্ত হন বা তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাহলে সংবিধানের আলোকে উচ্চ শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

পরিবেশ-রক্ষা আইন-১৯৯৫ এর ২০ ধারায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা মোতাবেক এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ মালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালায় দিন ও রাতকে বিবেচনা করে আবাসিক এলাকা, নীরব এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা এবং শিল্প এলাকায় শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

একই বিধান দ্য এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন-১৯৯৭ এর ৪ শিডিউলে বলা হয়েছে। শিডিউল ৫ অনুযায়ী যানবাহনের শব্দের মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪৬ ধারার ৩-এ বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারী এমন কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা যাবে না, যেমন হর্ন বা উচ্চ শব্দের ইঞ্জিন। ধারা ৪৬ এর ৪-এ আরও বলা হয়েছে, কোনো ত্রুটিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপকৃত কোনো মোটরযান সড়ক বা মহাসড়কে চালানোর অনুমতি দেয়া যাবে না।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। বিধি অনুযায়ী আরও বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবলের মধ্যে রাখতে হবে।

নীরব এলাকায় (হাসপাতাল ও স্কুল সংলগ্ন এলাকা) দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবল পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। মিশ্র এলাকায় (আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকা) দিনে ৬০ ডেসিবেল এবং রাতে ৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে। তবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাপ্তরিক কাজ, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের অনুষ্ঠান, বিমান, রেলগাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার ব্রিগেডের যান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপদ সংকেতের প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিধিমালা প্রযোজ্য নয়।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬-এর ৯ ধারা অনুসারে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে নীরব এলাকার বাইরে কোনো খোলা বা আংশিক খোলা জায়গায় সামাজিক অনুষ্ঠান, ক্রিয়া, কনসার্ট, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সভা বা অনুষ্ঠানে শব্দের মান মাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে।

২০০৬ এর বিধিমালার ধারা ১৭ অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা অতিক্রম করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেকোনো সময়ে যেকোনো ভবন বা স্থানে প্রবেশ করে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আটক করতে পারবেন এবং দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে প্রথম অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন (ধারা ১৮)। 

এ ছাড়াও দণ্ডবিধি-১৮৬০ সালের ২৬৮ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি কাজের মাধ্যমে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, আগুন, তাপ, শব্দ দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করেন, তবে তা গণউৎপাত বলে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ১৩২(ক) থেকে ১৪৩ ধারা অনুসারে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এই গণউৎপাত অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ বা নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে পারবেন। মানুষের শ্রবণ সক্ষমতার অতিরিক্ত, তীব্র, তীক্ষ্ম, অবাঞ্ছিত, কর্কশ বা অস্বস্তিকর শব্দ যা মানুষের শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা দেয় এবং শরীর ও মনের উপর নানাবিধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে শব্দদূষণ বলে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দূষণ ও পরিবেশগত মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে প্রতি বছর প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়, যেখানে বিশ্বব্যাপী এই হার ১৬ শতাংশ। আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বৃদ্ধিতে যেকোনো বয়সের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৪ ভাগ করে বৃদ্ধি পায়। তবে তা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে ২৭ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।

প্রতিটি মানুষের কান স্বাভাবিক শব্দ শোনার জন্য যথেষ্ট সংবেদনশীল। অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত শব্দ যে কোনো মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারীও হতে পারে।

শব্দদূষণের কারণে কানের বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচরণগত জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। চারপাশের বিকট এবং অস্বাভাবিক শব্দ মানুষের চিন্তা ও কাজ করার ক্ষমতাকে লক্ষণীয়ভাবে কমিয়ে দিচ্ছে। চরম অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে মানুষ। সহনশীলতার পরিবর্তে রাস্তায় ঝগড়া, মারামারি পর্যন্তও করতে দেখা যাচ্ছে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে, মানসিক অশান্তিতে ভুগছে, অল্পেই ক্লান্ত ও অমনোযোগী করে তুলছে, এ ছাড়াও বধিরতা দেখা দিচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব নয়েজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, স্নায়ুর সমস্যা, আলসার, মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, আত্মহত্যার প্রবণতা, হৃদরোগের মতো জটিল রোগের কারণ হতে পারে উচ্চমাত্রার শব্দ। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরও জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও শব্দদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হজমের সমস্যা, উদ্বেগ, বিরক্তি, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ এবং অন্যান্য ক্ষতিকর ও জটিল শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

আমাদের দেশে শব্দদূষণের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো যানবাহন। যানবাহনের অপরিকল্পিত ক্রয়-বিক্রয় এবং এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। স্বাভাবিকভাবে বাস, লরি, মোটরগাড়ি, ট্রাম্প, রেল, উড়োজাহাজ চলাচলের সময় সৃষ্ট শব্দ থেকে শব্দদূষণ হয়ে থাকে, এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন প্রকার বৈদ্যুতিক ও হাইড্রলিক হর্নের যত্রতত্র ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে শব্দের মাত্রা ৯০ বা ১১০ বা তার থেকেও বেশি ডেসিবলে চলে যাচ্ছে, যা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

কলকারখানা থেকে নির্গত বিকট শব্দ ও দালান-কোঠা নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মেশিনের অপপ্রয়োগ থেকেও আশেপাশে ব্যাপক শব্দদূষণ ঘটে। টিভি, রেডিও, টেপ রেকর্ডার, মিউজিক সিস্টেম (ডিজে) এর মতো সরঞ্জাম থেকে উৎপন্ন তীব্র শব্দ ও চিৎকারের কারণে শব্দ দূষণ হচ্ছে। এ ছাড়াও বিবাহ, মেলা, পার্টিতে ব্যবহৃত লাউড স্পিকার এবং আতশবাজির ব্যবহারও শব্দদূষণ করে থাকে।

পশুপাখির শব্দ, রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, হাটবাজারসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হতে শব্দদূষণ ঘটে। এ ছাড়াও ভিআইপি গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্নের ব্যবহার শব্দ দূষণের কারণ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িতেও ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজানোর প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমান শব্দদূষণের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। সচেতনতার অভাবে ধীরে ধীরে এটি মহামারি আকার ধারণ করছে। অথচ এই সমস্যাটি মানবসৃষ্ট ও সমাধানযোগ্য। একটু আত্মসচেতন ও আইন মেনে চলার প্রবণতাই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বিদ্যমান আইনে অতিমাত্রার শব্দ উৎপাত বা দূষণের জন্য জরিমানার বিধানগুলো অপর্যাপ্ত, যা দ্রুত বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এ ছাড়া মানুষের প্রতি মানুষকে সহনশীল ও ধৈর্যশীল হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও যত্রতত্র সবধরনের হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে, সামাজিক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানস্থলের মধ্যেই গান বা যন্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের ফলেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বি.দ্র.- (এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। নিউজজি২৪ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন