শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩১ ফাল্গুন ১৪৩১ , ১৫ রমজান ১৪৪৬

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

এবারের মে দিবস: 'জাতীয় ন্যুনতম মজুরির' জন্য লড়তে হবে

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ২৮ এপ্রিল , ২০২৪, ১১:২৬:১৫

1
  • এবারের মে দিবস: 'জাতীয় ন্যুনতম মজুরির' জন্য লড়তে হবে

দেশের শ্রমিকরা গার্মেন্টস, পাটকল, নির্মান, পরিবহন -- ইত্যাদি ইত্য্যাদি বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে।  প্রত্যেক সেক্টরে নির্দিষ্ট পৃথক-পৃথক নিম্নতম মজুরী সহ পৃথক-পৃথক মজুরীর স্কেল নির্ধারিত করা আছে, অথবা আইএলও-র বিধান অনুযায়ি তা থাকার কথা আছে।  সব সেক্টরের ও সব পেশার যে কোন শ্রমজীবীর জন্য জাতীয়ভাবে সর্বনিম্ন মজুরী নির্ধারণ করার জন্যও আইএলও-র বিধান রয়েছে।  কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও কোন ‘জাতীয় নিম্নতম মজুরি’ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।  দেশের সব শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য 'জাতীয় ন্যুনতম মজুরি' আদায়ের লড়াই এগিয়ে নেয়া আজ বিশেষভাবে জরুরী।          

‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরী’ (অর্থাৎ, যে কোন পেশার যে কোন শ্রমজীবীর জন্য সর্বনিম্ন মজুরি) ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে হবে- এবার মে দিবসে এটিই দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রধান দাবী।  মে দিবসের মিছিল, সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানগুলোতে এটিই হবে শ্রমিকদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত ও প্রান থেকে বেড়িয়ে আসা প্রধান স্লোগান।  বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকরা নিজ নিজ মতো করে পৃথক-পৃথক ন্যূনতম মজুরীর দাবীও সামনে আনবে।  যেমন কিনা - গার্মেন্টসের শ্রমিকরা তাদের ন্যুনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকার জন্য যে সংগ্রাম করছে, সেটিও এবারের মে দিবসের একটি প্রধান দাবী হবে। 

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদেরকে লাগাতারভাবে সংগ্রাম করতে হয়।  তবে, ঐতিহাসিক মে দিবসের আন্দোলনে সেটি প্রধান দাবি ছিল না।  আট ঘণ্টা কাজের দাবিটিই ছিল মে দিবসের সংগ্রামের প্রধান দাবি।  মে দিবসে দাবিটির সাথে আরও দশটা দাবি উচ্চারিত হইয়ে থাকে। অন্য সব দাবিকে ছাপিয়ে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ ও সেই সাথে মজুরী বাড়ানোর দাবীটি হয়ে উঠবে এবারের মে দিবসে প্রধান স্লোগান।  ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরির’ দাবিটি কেন ও কী কারণে এখনকার সময়ের প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে?

'৮ ঘন্টা কাজের' দাবিটি ছিল মে দিবসের সংগ্রামের মূল দাবি।  শ্রমিকরা বলেছিল, দিনের ২৪ ঘণ্টাকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করে চলবো।  ৮ ঘণ্টা কাজ করবো, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম করবো, আর বাকী ৮ ঘণ্টা বিনোদনে ব্যয় করবো।  পরে ‘বিনোদন’ কথাটির বদলে বলা হতে থাকে 'সংগ্রামের’- কথাটি।  শ্রমিক শ্রেণীর সচেতন সংগ্রামী অংশ থেকে ‘৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা সংগ্রাম’- এই আওয়াজ তুলে ধরা হয়। 

দুনিয়ার দেশে-দেশে সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে।  এটি একটি স্বার্বজনীন জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হয়।  ‘৮ ঘন্টা কাজের’ এই দাবিটি আজ দুনিয়াব্যপী স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দাবিটির মর্মকথা শুধু ঘড়ির কাটার হিসেবে ৮ ঘণ্টা কাজের বিষয় নয়, তার আসল মর্মকথা হ’ল- শ্রমিকদের ‘কাজের সময় কমাতে হবে’।  পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ৮ ঘন্টা কাজের দাবিটি আরো অগ্রসর হয়েছে।  তা এখন ‘সপ্তাহে ৪০ ঘন্টার বেশি কাজ নয়’, -এই দাবিতে পরিণত হয়েছে।  কয়েকটি দেশে সে দাবি আদায় করাও সম্ভব হয়েছে। 

‘মজুরী বাড়ানোর’ দাবির তুলনায় কাজের সময় কমানোর’ দাবির সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেশি।  এই দাবি শ্রেণি হিসাবে শ্রমজীবী মানুষের হাতে তার স্বার্থকে আরও বেশি মাত্রায় রক্ষা করে।  এই দাবি আরও গভীর ও উন্নত।  তবে তার চূরান্ত ফলাফল হাতে পেতে সময় লাগে।  কিন্তু, আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষরা আজ ‘হালুয়া টাইট’ অবস্থায়।  তারা আজ জীবন-জীবিকার চরম সংকটের সম্মুখিন। দুরবর্তী স্বার্থের স্বপক্ষে স্লোগান তোলার পাশাপাশি তাই এখন তার কাছে  ‘বেঁচে থাকা’ নিশ্চিত করার জন্য আওয়াজ তোলা বিশেষভাবে জরুরী। 

সেকারণে, ‘মজুরি বাড়াতে হবে’- শ্রমজীবি মানুষের কাছে এই দাবীটি বর্তমানে তাদের ‘অস্তিত্ব রক্ষার’ মতো সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। প্রায় সব দেশে, এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশে, তা এবারের মে দিবসের স্লোগানগুলোর মধ্যে এক নম্বরে উঠে এসেছে। ‘মজুরী বাড়ানো’ ও ‘কাজের সময় কমানো’ – কোনটিকে 'গুরুত্ব' ও 'জরুরী'  এই দু দিক থেকে বিবেচনা করলে অধিকতর বলে বিবেচনা করা যায়?  বিষয়টির প্রতি একটু নজর দেয়া যাক। 

প্রথমে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক ‘মে দিবসের’ ইতিহাসের দিকে।  ১৮৮৬ সালে আমেরিকায় ১১ হাজারেরও বেশি কল-কারখানায় প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক এক অভুতপূর্ব শক্তিশালী ধর্মঘট আন্দোলন শুরু করেছিল।  এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি।  সেই বছরের ১ মে তারিখে আমেরিকার শিকাগো শহরে হাজার-হাজার সংগ্রামরত শ্রমিকের সমাবেশে পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষন ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল।  সে ঘটনা সব দেশে তুমুল আলোড়ণ তুলেছিল।  গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক সংহতি।  প্রান পেয়েছিল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান।  বীরত্বপূর্ণ সেই লড়াইয়ের ঘটনাকে চির অম্লান করে রাখার মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিতে প্রতি বছর মে মাসের ১ তারিখকে দুনিয়ার দেশে-দেশে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়েছিল।

‘কাজের সময়’ হলো শ্রমিক-স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয়।  পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা কাজ করে প্রধানতঃ ‘বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহের’ উদ্দেশ্যে।  তার শ্রমশক্তিকে, সে বিক্রি করে মজুরির বিনিময়ে।  প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে সে তার ক্ষয়ে যাওয়া শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করতে, অন্য আর দশটি পণ্যের মতোই, তার নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণ-শিক্ষা-চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাই- ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। 

শ্রমশক্তি দেয়ার ক্ষমতা অব্যাহত রাখার জন্যই তাকে তার শরীর ঠিক রাখতে হয়।  এজন্য প্রয়োজন হয় খাওয়া-খাদ্য-পুষ্টি ইত্যাদির।  সাথে সাথে প্রয়োজন হয় ন্যূনতম ঘুম, বিশ্রাম ও বিনোদনের।  এসবই হলো একজন শ্রমজীবী মানুষের ‘বেঁচে থাকার আয়োজন’-এর ব্যাপার।  যেমন কিনা, রান্না করতে হলে হাড়ি, পাতিল, চুলা, মসলা-পাতি, রান্নার উপকরণাদি ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়।  এগুলো হলো ‘রান্নার আয়োজন করা’ মাত্র।  কিন্তু রান্নার আসল কাজটি হলো ভিন্ন ব্যাপার। সেই আসল কাজটির জন্যই তো এতো সব আয়োজন।  এবং সেই কাজটি আসে পরে।

ঠিক তেমনই, বেঁচে থাকার জন্য ব্যবস্থা-পাতি করার উদ্দেশ্যেই শ্রমিককে মজুরির বিনিময়ে তার শ্রমশক্তি বিক্রি করতে হয়।  কিন্তু, শুধু 'বেঁচে থাকার আয়োজন করার' মধ্যেই বেঁচে থাকার আসল অর্থ সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।  শ্রমিককে সেই 'বেঁচে থাকার প্রকৃত সময়' বের করে নিতে হয় তার শ্রম বিক্রি, বিশ্রাম আর বিনোদনের সময়ের বাইরে।  'কাজের সময়' না কমাতে পারলে তার 'প্রকৃত বেঁচে থাকার সময়' বের করা সম্ভব নয়।  আর বাঁচার সময় বের করতে পারলে তখনই কেবল একজন শ্রমিকের মূল্য শুধু  শ্রমশক্তি প্রদানের একটি উৎস রূপে সীমাবদ্ধ থাকে না, সে হয়ে ওঠে একজন জীবন্ত মানুষ। 

এই সময়টিতেইই জীবন তার কাছে অর্থবহ আনন্দময় হয়ে ওঠে।  তার সৃজনশক্তি অবারিত হয়ে ওঠে।  সে হয়ে ওঠে মানব সভ্যতার সচেতন সৃজনশীল স্রষ্টা, মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজের এক মুক্ত সত্তা।  শোষণের জিঞ্জির ভেঙে সাম্যবাদী সভ্যতা নির্মাণের মহাসংগ্রামের সে হয়ে ওঠে একজন বিপ্লবী সৈনিক। একারণেই মজুরি বৃদ্ধির দাবির তুলনায় কাজের সময় কমানোর দাবিটি অনেক বেশি শ্রেণী-তাৎপর্য সম্পন্ন। 

পুঁজিবাদী সমাজে মজুরি নির্ধারণ হলো একটা দরকষাকষির ব্যাপার।  এটা ব্যক্তিগত স্তরে অথবা যৌথভাবে উভয় প্রকারে হতে পারে। মালিক শ্রেণি মজুরি বাড়াতে চায় না, বরঞ্চ শ্রমিকের মজুরি কমাতে পারলেই তার স্বার্থ আদায় হয়।  কিন্তু শ্রমিক তার মজুরি যতো বেশি পরিমানে সম্ভব বাড়াতে চায়।  পুঁজিবাদে এই দ্বন্দ অনিবার্য্য।  এই দ্বন্দের কারনে পুঁজিবাদে ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ অবশ্যম্ভাবি।  সংগ্রাম করা ছাড়া শ্রমজীবী মানুষ তার মজুরি বাড়াতে স্বক্ষম হয়না। 

শ্রমিকের সংগ্রামের ফলে শেষ পর্যন্ত মালিককে মজুরি বাড়াতে হয়।  কিন্তু, মালিক যে পরিমাণে মজুরি বাড়ায়, পর্যায়ক্রমে দ্রব্যমূল্য তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে সে শ্রমিককে ঠকানোর ব্যবস্থা করে।  বুর্জোয়া মালিক শ্রেণি যদি মজুরি বাড়ায় ১০ টাকা, তাহলে ক্রমান্বয়ে  জিনিসের দাম ২০ টাকা বাড়িয়ে সে তা পুষিয়ে নেয়।  তাই, ‘মজুরি বৃদ্ধি’ শ্রমিকদেরকে সাময়িক সুবিধা দেয় বটে, কিন্তু সেই ‘সুবিধা প্রাপ্তি’ স্থায়ী হয়না।  

কিন্তু, ‘কাজের সময়’ কমাতে পারলে তা সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীকে প্রকৃত সুফল এনে দেয়।  আলাদা করে একজন শ্রমিককে ছাঁটাই করে ‘কাজের সময় কমানোর অর্জন’ তার কাছ থেকে আলাদা করে কেড়ে নেয়া যায় বটে, কিন্তু সমগ্রভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে সে অর্জন থেকে বঞ্চিত করা যায় না। কারণ, কাজের সময় কমালে, উৎপাদনের ক্ষেত্র আগের পরিমান যদি অব্যাহত রাখতে হয় তাহলে মালিককে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়।  অন্ততপক্ষে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা কমানোর সুযোগ  মালিকের থাকে না।

বাংলাদেশে ৮ ঘণ্টা কাজের আইন থাকলেও সে আইন এখনো বহু জায়গায় বাস্তবে কার্যকর করা হয়না।  গ্রাম ও শহরের অসংগঠিত নানা খাতের সিংহভাগ শ্রমজীবী মানুষের ক্ষেত্রে নিদারুণ অভিশাপ হিসেবে তা বিদ্যমান।  ক্ষেতমজুর, দিনমজুর, গৃহকর্মী প্রমূখের অবস্থা এক্ষেত্রে অতি করুণ। 

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-খামার প্রভৃতিতে কাজের সময় নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখা নিশ্চিত করা দেখাশুনার জন্য কেউ নেই। এমনকি বড়-মাঝারি অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানেও ৮ ঘণ্টা কাজের সময় কার্যকর থাকে না। আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।  আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে সংগঠিত ইতিহাস সৃষ্টি করা সংগ্রামের ১৩৭ বছর পরেও বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য এই দাবি আজও প্রতিষ্ঠা পায়নি।  ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি এখনো বাংলাদেশে মে দিবসের অনুষ্ঠানমালায় শ্রমিকদের একটি প্রধান দাবি হয়ে আছে।

এবারের মে দিবসে এই ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে ছাপিয়ে সামনে এক নম্বরে উঠে এসেছে, ২০ হাজার টাকা জাতীয় নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের দাবিটি।  তা হয়েছে একারণে, যে হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে পুরানো মজুরিতে অধিকাংশ শ্রমিকদের ক্রয় ক্ষমতা (প্রকৃত আয়) নামতে নামতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে তাদের বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

  সংসার খরচ সহ সবকিছুর দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও শ্রমিকের মজুরি বাড়েনা।  বাড়লেও তা বাড়ে তুলনামুলকভেবে ধীর গতিতে।  ফলে শ্রমিক পরিবারগুলোর ‘কেনার ক্ষমতা’ অর্থাৎ তাদের ‘প্রকৃত আয়’ ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে।  এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, বাজারে অন্যান্য জিনিসের দাম যে পরিমানে বাড়ে, সেই অনুপাতে মজুরির পরিমান বাড়াটা একান্ত যুক্তিসংগত ও বাঞ্চনীয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছিল ১২৫ টাকা।  সে সময় এক ভরি সোনার দাম ছিল ৩০০/৪০০ টাকা।  গত ৫০ বছরে তা ২৫০ গুনেরও বেশি বেড়ে এখন ভড়িপ্রতি ১ লক্ষ টাকায় উঠেছে।  সেই অনুপাত অনুসারে বর্তমানে ন্যুনতম মজুরির পরিমান নির্ধারিত হওয়া উচিত ৩৫ হাজার টাকারও বেশি।  ধানমন্ডি-গুলশান-বনানীর জমির তখনকার ও এখনকার দামের অনুপাত হলো ১,০০০ গুনেরও বেশি।  সে হিসাব তখনকার ১২৫ টাকা হল বর্তমানে ১২৫ লক্ষ টাকার সমান।

থাকুক না হয় সোনার বাজারের কিম্বা গুলশান বনানীর জমির মূল্যের হিসাব!  বরঞ্চ নজর দেয়া যাক বহুল প্রচারিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে।  সেখানে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য হার ৫০% কমিয়ে ফেলার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছিল। 

এ সময়ের মধ্যে ন্যূনতম মাথাপিছু আয় ২ ডলার নিশ্চিত করা হবে বলে বহুদিন ধরে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয়েছিল।  সেই হিসাবে ৫ সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারের মাসিক আয় ২০১৫ সালেই ন্যূনতম ৩০০ ডলার হওয়ার কথা।  পরিবারে দুইজন উপার্জনক্ষম মানুষ থাকলে প্রত্যেকের মাসিক আয় ১৫০ ডলার হওয়ার কথা- বর্তমানে  যার মূল্য ১৬ হাজার টাকার বেশি। 

অব্যাহতভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিলে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ২০ হাজার টাকার কম নির্ধারণ করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।  অবিলম্বে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ না করা হলে এবং তার পরিমান ২০ হাজারের কম হলে তার দ্বারা একথাই প্রমাণিত হবে যে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার গোটা ব্যাপারটাই একটি ভাওতাবাজী, সুচতুর প্রচারণা অভিযান, দারিদ্র্য শ্রমজীবী জনগণকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে নির্জীব করে রাখার ফন্দি এবং ‘দারিদ্র ব্যবসা’ চালিয়ে  সমাজের উঁচু তলার কর্মকর্তা এবং স্বঘোষিত সুশীল সমাজের দাবিদার বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনের পকেট ভরার একটি প্রয়াস বৈ অন্য কিছু নয়।  

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০০ টাকারও কম।  এখন তা ৩০০ গুন বেড়ে হয়েছে ৩ লক্ষ টাকারও বেশি।  ১৯৯৩ সালে নির্ধারিত ১২৫ টাকার ন্যূনতম মজুরি আনুপাতিক হিসাবে এখন  ৩৭,০০০ টাকা হওয়া যুক্তিসংগত ও বাঞ্ছনীয় নয় কি?

আরও না হয় দৃষ্টি দেয়া যাক চাল-ডাল-গমের দামের প্রতি।  ১৯৭৩/১৯৭৪ সালেও স্লোগান দেয়া হতো ’২০ টাকা মণ দরে চাল চাই - ১০ টাকা মন দরে গম চাই’।  সেই মোটা চাল এখন তার ১২০ গুণ বেশি দামে কিনে খেতে হয়।  একজন শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি যদি সেই অনুপাতেও বাড়ানো হয় তাহলেও তার পরিমান দাড়ায় ১৫ হাজার টাকা।

একজন শ্রমিক যদি ১৫ হাজার টাকা মজুরিও পায়, তা দিয়ে তার পরিবারের জীবনমান ৫০ বছর আগের অভাবগ্রস্থ অবস্তাতেই থেকে যাবে।  তাহলে ৫০ বছর ধরে চলা ‘উন্নয়নের’ ফসলে তার ভাগটি গেল কোথায়? 

ক্ষমতাসীন মহল হরদম দাবি করছে যে, দেশে বিপুল ‘প্রবৃদ্ধি’ হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দেশ ‘উন্নয়নের রোল মডেলে’ পরিণত হয়েছে -ইত্যাদি। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে এই ‘উন্নয়ন’ ও ‘প্রবৃদ্ধির’ পেছনে গ্রাম-শহর-প্রবাসের শ্রমজীবী মানুষের অবদানই প্রধান। তাই, ‘উন্নয়নের’ ফসলের প্রধান অংশ তাদেরই প্রাপ্য। তার সবটা না হলেও, অতি সামান্য শতাংশও কি তারা পাওয়ারর অধিকার রাখে না? ন্যুনতম মজুরি হিসাবে ৫হাজার টাকা করে যুক্ত করলে ১০ কোটি শ্রমজীবি মানুষের জন্য সে পরিমান দাঁড়ায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।  ৫০ বছরের সমুদয় প্রবৃদ্ধির তা ১ শতাংশও হবেনা।  গত ১৬ বছরে যে ১১ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তা তার ৫% শতাংশেরও কম।  তাই, ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ হিসাবে ২০ হাজার টাকা দাবি করা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

না হয় আরও জীবন ঘনিষ্ট বিষয় বিবেচনায় নেয়া যাক!  গবেষক-বিশেষজ্ঞরা একমত যে, দারিদ্র্যসীমার উপরে থেকে জীবন যাপনের জন্য একজন মানুষের অন্তত ২১০০ কিলো ক্যালোরি পরিমাণ আহার গ্রহণ অপরিহার্য।  এই হিসাব সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত।  শরীরে এই পরিমান ক্যালোরি গ্রহণ নিশ্চিত করতে একজনও শ্রমিকের আহারের পেছনে দৈনিক খরচ পরে ১২৫ টাকার বেশি। 

একটি শ্রমিক পরিবার তার আহারের পেছনে খরচ করে তার আয়ের প্রায় ৪৫%, আর বাসস্থান, কাপড়-চোপর, চিকিৎসা ইত্যাদি অন্যান্য অত্যাবশ্যক কাজে খরচ হয় অবশিষ্ট ৫৫% টাকার পরিমাণে যা দাঁড়ায় আরও ১৫২ টাকার কিছু বেশি। এই হিসাব অনুযায়ী দারিদ্র্যসীমার উপরে কোনোরকমে জীবনযাপন করতে হলে একটি শ্রমিকের ন্যূনতম দৈনিক আয় হওয়া উচিত ২৭৭ টাকা। 

৫সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারের ক্ষেত্রে এই আয় হওয়া উচিত দৈনিক ১৩৮৫ টাকা।  অর্থাৎ দরিদ্র অবস্থায় জীবন নির্বাহ করতে হলে সংসারের মাসিক আয় হওয়া উচিত প্রায় ৪১,৫৫০ টাকা।  পরিবারের দুজন কর্মক্ষম মানুষ থাকলে সে হিসাবে প্রতিজনের আয় হওয়া প্রয়োজন ২০,২৭৫ টাকা।  এর কম আয় হলে সেই শ্রমিক পরিবারকে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যেতে হবে।

একথা ঠিক যে সব শ্রমজীবী মানুষ নিম্নতম মজুরির হারে কাজ করে না।  বিভিন্ন গ্রেড অনুযায়ী কেউ কেউ তার চেয়ে বেশি মজুরিতে কাজ করে। কিন্তু অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ কাজ করে তার চেয়ে অনেক কমে, এমনকি নামমাত্র মজুরিতে।  এই ব্যপক সংখ্যক শ্রমিক পরিবারকে কেন দারিদ্র্যসীমায় বাঁচার জন্য যা প্রয়োজন তার চেয়ে কম আয়ে জীবনযাপন করতে হবে?

বিভিন্ন খাতে আলাদা আলাদা ‘ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারিত হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট খাতে নির্ধারিত ‘ন্যূনতম মজুরির’ উর্দ্ধে বিভিন্ন গ্রেড অনুসারে মজুরি হার নির্ধারণ করা হয়। 

এগুলো মুলতঃ সংগঠিত খাতে প্রয়োগযোগ্য।  এর বাইরে  বিশাল অসংগঠিত খাতে ‘ন্যুনতম মজুরি হার’ প্রয়োগযোগ্য নয়।  কিন্তু যেহেতু ‘জাতীয় ন্যুনতম মজুরি’ সারা দেশের সব শ্রমজীবীর মজুরি-হারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেকারণে এর কম মজুরিতে কোন নিয়োগ করা আইনত অবৈধ বলে গন্য হবে।  কোন সেক্টরেই নিজস্ব  নিম্নতম মজুরি এবং সেখানে উপরের গ্রেডের মজুরির পরিমাণ এই নির্ধারিত ‘জাতীয় ন্যুনতম মজুরির’ পরিমাণের কম হওয়ার সুযোগ থাকবে না।  

আশেপাশের দেশগুলোর ‘জাতীয় নিম্নতম মজুরির’ সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশে নির্ধারিত নিম্নতম মজুরি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ভুটানের তুলনায় অর্ধেকের কম, এবং কতক ক্ষেত্রে তা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মাত্র।

শ্রমিকদের জন্য ‘মজুরি-কমিশন’ গঠনে গরিমসি ও অবজ্ঞা-অবহেলা থাকলেও ‘পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি প্রমুখের বেতন-ভাতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হয়েছে। এদের সংখ্যা এদেশের কর্মক্ষম মানুষের মোট সংখ্যার ৭% এর বেশি নয়।  কিন্তু এর ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে।  যাদের মজুরি বা আয় বাড়েনি অর্থাৎ অবশিষ্ট ৯৩% মানুষের জীবনে তার প্রভাব হয়েছে ভয়াবহ। আয় বাড়ার বদলে মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের ক্রয় ক্ষমতা (প্রকৃত আয়) আরো কমে গেছে।  

এদিকে মজুরি ও বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ানো হয়েছে। পে-স্কেলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত প্রায় ১:১০করা হয়েছে, যা কিনা দীর্ঘদিনের গণদাবির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বীকৃত ১:৬ এর অনেক বেশি (দেড় গুণেরও বেশি)।  অন্যদিকে, একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরি ও পে-কমিশনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১:২৫-এ।  এ ধরনের কুৎসিত মাত্রার বৈষম্য শুধু অমানবিকই নয়, তা সমাজে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির উপাদানকে বাড়িয়ে তুলছে।

এবিষয়ে এরকম আরও বহু যুক্তি দেয়া যায়। কিন্তু যেটুকু উল্লেখ করা হয়েছে সেসব তথ্য-যুক্তি-ব্যাখ্যার পর আরও কিছুর প্রয়োজন হয় কি? 

এই পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে আজ যেমন গার্মেন্ট শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা আদায়ের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, তেমনি অন্যন্য সকল শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের ন্যুনতম মাসিক মজুরি যেন কোন অবস্থাতেই ২০ হাজার টাকার কম না হয় সেজন্য ‘জাতীয় ন্যুনতম মজুরি’  নির্ধারণের জন্য আন্দোলনে দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে।  এটাই এবারের মহান মে দিবসে আমাদের একটি প্রধান কর্তব্য।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন