বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ , ২১ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

ইতিহাসের চোখে বঙ্গবন্ধু

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১৩:২৭:২৮

324
  • ইতিহাসের চোখে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। ইতিহাস-ই   যেমন কিনা তাকে সৃষ্টি করেছিল, তেমনি তাঁর হাতেই আবার সৃষ্টি হয়েছিল ইতিহাস। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে দেখবে তার নিজশ্ব বিচারে। একজন ব্যক্তির চোখ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিচার করাটি হলো ভিন্ন মাত্রার একটি বিষয়। একেক মানুষের চোখে তা হবে একেক রকম। আমার চোখে তা কী?বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সান্বিধ্যের অনেক ঘটনা আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেসব স্মৃতিচারণে আজ যাবো না। শুধু তাকে আমার প্রথম চাক্ষুষ দেখা এবং তাঁর সাথে আমার সর্বশেষ স্বাক্ষাতের ঘটনার কথা উল্লেখ করবো। 

আমি কোন সময়ই তার দল করি নাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি চাক্ষুষ প্রথম দেখেছিলাম আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে  ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে তাঁকে  প্রথম দেখতে পাওয়ার সে কথা। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুনের হরতালে রাস্তায় পিকেটিং করার সময় আমাকে গ্রেফতার করে সামারি মোবাইল কোর্টে ১ মাসের জেল দিয়ে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। রাতটা কোনো রকমে  জেলখানার ‘আমদানি’ ওয়ার্ডে রেখে পরদিন ভোরে আমাকে হাজির করা হয়েছিল ‘কেইস টেবিল’ চত্ত্বরে। 

এই চত্বরের একদিকে ছিল জেলাখানার রান্নাঘর (বা যাকে সবাই বলতো ‘চৌকা’)। তার বিপরীত দিকে ছিল দেওয়ানী, পুরান বিশ সেল, নতুন বিশ সেল ইত্যাদির সমন্বয়ে দেয়াল পরিবেষ্টিত 'দেওয়ানি' এলাকা ( ১০ বছর পর ১৯৭৬ সালে আমাকেও লম্বা সময় ধরে এখানে রাখা হয়েছিল)। 'দেওয়ানি এলাকায়' প্রবেশের জন্য ছিল একটি কাঠের দরজা।  বেলা ১০টা/ ১১টার দিকে দেওয়ানী এলাকার দরজাটি খুলে গিয়েছিল এবং সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত পাইপ মুখে একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি গেইটের ভেতরে দাড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়েছিলেন। সবাই বলে উঠেছিল, ‘ঐ তো শেখ সাহেব, আমাদের দেখে হাত নাড়ছেন!’ দু'এক মিনিটের মধ্যে গেইটটি বন্ধ করে তাঁকে আমাদের দৃষ্টির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ক্ষনিকের জন্য এবং দুর থেকে হলেও জেলখানাতেই সেদিন এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমার প্রথম চাক্ষুষ দেখা। 

বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার প্রথম সামনা-সামনি কথা হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হিসেবে। ডাকসু-র ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর কথাবার্তা, দেখা স্বাক্ষাত বিশেষ নিবিড় হয়ে উঠেছিল। তিনি আমাকে 'তুমি' সম্বোধন করতেন। আমি তাঁকে 'মুজিব ভাই' বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ৩ বছরের কিছুটা বেশি সময়কাল জুড়ে  ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের প্রথমদিকে (তারিখটা সঠিক মনে নেই) বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা। স্বল্প সময়ের এই স্বাক্ষাতকালে তিনি আমাকে বলেছিলান ' সেলিম, তোমার (অর্থাৎ পার্টির) নেতারা আমার নিরাপত্তার বিষয়ে আশংকা জানাতে এসেছিলেন। তাদেরকে আমি কি বলেছি জান? বলেছি, দাদা আমি বরঞ্চ আপনাদের নিয়ে বেশি চিন্তিত। সতর্ক থাকবেন। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। কোন বাংগালী আমাকে গুলি করতে পারবে না। কেও গুলি করতে গেলে তার হাত কেঁপে যাবে'। তারপর, আগস্টের ১২ তারিখে শেখ শহিদুল ইসলামের ৩২ নম্বরের বাসার রুমে ফোন-কল দেয়ার পর আমি অনর্গল  কিছু কাজের কথা বলে যাওয়ার পর ওপার থেকে জবাবের কন্ঠ শুনে বুঝতে পেরেছিলাম যে ফোনটা ধরেছেন বঙ্গবন্ধু নিজে। সামান্য কিছু বিষয়ে তখন তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল।

যাই হোক, এবার তবে 'ইতিহাসের বিচারে বঙ্গবন্ধু' প্রসঙ্গে আসা যাক। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা হলো একটি প্রধান নির্নায়ক সূত্র। সমকালীন ইতিহাসে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন হলো একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেটি ছিল কালজয়ী। জাতির ইতিহাসে তা এক ঐতিহাসিক নব অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। উন্মুক্ত করেছিল যুগান্তকারী অগ্রগতির নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। সে সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি কী পারিনি, কিম্বা পারলেও তা কতটুকু পেরেছি - সেগুলো হলো একটি স্বতন্ত্র বিবেচনার বিষয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সে সত্য অস্বীকার করা যায় না। এ ইতিহাসের নির্মাতা ছিল কে বা কারা? সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্থান কোথায়ও কতটুকু? বঙ্গবন্ধুকে বিচার করতে হবে প্রধানত এই বিবেচনার আলোকে।

একথা ঠিক যে, চূড়ান্ত বিচারে জনগণই হলো ইতিহাসের নির্মাতা। সাথে সাথে একথাও অসত্য নয় যে, ইতিহাস সৃষ্টিতে ব্যক্তির ভূমিকাকেও অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায় না। ‘ইতিহাসই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের’ জন্ম দেয়। ইতিহাসের আপন প্রয়োজনেই বিশেষ মুহূর্তে ইতিহাস নিজেই এসব ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে’ যুগান্তকারী ঘটনাবলীর প্রাণ কেন্দ্রে এনে দাড় করিয়ে দেয়। ইতিহাসের হাতে তৈরি হওয়া সেই ব্যক্তির ভূমিকাই তখন আবার ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রিক বা নিয়ামক হয়ে ওঠে। জনগণ ও ব্যক্তির ভূমিকা এভাবে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতেই নতুন ইতিহাস নির্মিত হয়ে থাকে। 

সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়, আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মাণে, জনগণই ‘স্রষ্টার’ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এ বিষয়েও কোন সন্দেহ থাকতে পারে না যে, মুক্তিযুদ্ধের নির্মাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা সেক্ষেত্রে ছিল কেন্দ্রিক ও বহুলাংশে নিয়ামক। কালক্রমে ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকালে জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের 'নেতার' আসনে অবস্থান নিয়ে, সেই জনগনকেই সাথেত নিয়ে,  তিনি বাংলাদেশের স্থপতি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা, বাংলাদেশের জন্ম - এসব ঐতিহাসিক অর্জন সম্ভব হয়েছিল প্রধানতঃ জনগণের অমোঘ শক্তির ফলে। তাছাড়া, তা সম্ভব হয়েছি শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাষানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ অনেক ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের’ ত্যাগ-তিতীক্ষা-অবদানে। এসব নেতারাও ছিলেন কালজয়ী ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব’। কিন্তু তাদের মধ্যে যিনি ঠিক ক্রান্তিকালীন সময়টিতে জনগণের সংগ্রাম, আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন-সাধনা ও মনের কথাকে সবচেয়ে উপযুক্ত ও বলিষ্ঠভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে স্বক্ষম হয়েছিলেন তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে কারনেই একথা নির্দিধায় বলা যায় যে একাত্তরের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, একদিকে জনগণের অন্তরে এবং একইসাথে বাস্তব বিচারে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল অন্যান্য এসব ‘ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের’ ওপরে, এক নম্বরে। এই সত্যকে অস্বীকার করাটি হবে ভুল। তেমনি আবার, সব কিছুই বঙ্গবন্ধু দ্বারাই এককভাবে নির্মিত হয়েছিল এবং অন্যান্য নেতাদের ও জনগণের ভূমিকা ছিল কেবল ‘পার্শচরিত্রের’, এমন ভাবনাও হবে ভ্রান্ত। উভয় ধরনের ভাবনাই ‘অন-ঐতিহাসিক’ ও একমুখীন পক্ষপাতিত্বের  দোষে দুষ্ট।

সমাজ ও রাজনীতিতে ‘নেতা’ বা ‘নায়ক’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নিতে পারেন অনেকেই। মাঝে মাঝে অসাধারণ ক্যারিশমা সম্পন্নরা ‘বড় নেতা’ অথবা ‘মহানায়কের’ আখ্যায়ও ভূষিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তবে, তারা প্রায় সবাই সমসাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটের নায়ক। কিন্তু ‘ইতিহাসের নায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। যুগ-যুগান্তরের পরিক্রমায় হাতে গোনা এক-আধজনই কেবল ‘ইতিহাসের নায়ক’ হয়ে উঠতে পারেন। ইতিহাস তার আপন তাগিদেই সেরূপ ‘নায়কের’ উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ‘ইতিহাসের নায়ক’-ই হয়ে ওঠেন ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই একজন কালজয়ী পুরুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশের একজন বড় মাপের নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের নায়ক’। আরো সত্য করে বললে, তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের এক মহানায়ক’। 

রাজনৈতিক-সামাজিক পরিমন্ডলে এক ক্রমঅগ্রসরমান বিবর্তন ও উত্তোরণের ধারার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়কের এই অবস্থানে উত্থিত হতে পেরেছিলেন। তার ভাবনা-চিন্তা-আদর্শবোধ-জীবন দর্শন ইত্যাদি আত্ম-পরিচয়ের বিভিন্ন মৌলিক উপাদানগুলো ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে তাঁর এক সময়কালের অবস্থান থেকে পরবর্তী অন্যএক সময়কালের অবস্থানের অগ্রসর উত্তোরণ ঘটেছিল। উত্তোরণ ও বিবর্তনের এই গতি কোনোদিন বন্ধ হয়নি, অব্যাহত থেকেছে তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। 

রাজনীতির অনেক আঁকা-বাঁকা পথ ধরে তাঁকে চলতে হয়েছে, অনেক আগু-পিছু করে করে তাকে রাজনীতির পথ পরিক্রম করতে হয়েছে। বাস্তবতার প্রতিকূলতার মুখে কখনো কখনো তাঁকে  আপসও করতে হয়েছে। কিন্তু একথা বলা যায় যে সাধারন বিচারে তার অবস্থানের সার্বিক বিবর্তনের গতি ছিল সামনের দিকে, প্রগতি অভিমুখে। এটিই ছিল স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। কেন? কারণ, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক, ছিলেন জনতার নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক পন্ডিত তিনি কখনই ছিলেন না। তিনি একজন সর্বজ্ঞানী স্কলার অথবা কোনো এক বা একাধিক বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা সম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞও ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন নেতা। তিনি ছিলেন মানুষের লোক। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, বিচার-বিবেচনার রসদ সঞ্চয় করতে পারতেন। সব বিষয়ে শেষ ভরসা করতেন মানুষের ওপরে। মানুষের ওপর, জনতার ওপর তাঁর এহেন অপার ভালোবাসা ও নৈকট্যই তাঁর ক্রমবিবর্তনের প্রগতিমুখীন হওয়াটাকে স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।

শুরুতে তিনি ছিলেন এক দুরন্ত কিশোর - 'মুজিবর'। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তার পর মুজিবর রহমান অথবা শেখ মুজিবর রহমান। তার পর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছিল ‘শেখ সাহেব’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন দেশের স্থপতি এবং ‘জাতির পিতা’। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই ঘটেছিল তার অবস্থানের উত্তোরণ। 

তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে তার চিন্তাধারা-জীবন-দর্শনেও উত্তরণ ঘটেছিল। শুরুটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসেবে। কিন্তু সেসময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা প্রগতিমুখীন যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সারোওয়ার্দ্দী সাহেবের অংশের অনুগামী। তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে। তিনি একই সাথে ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট - এই তিন দলের ঝান্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে সঙ্গী-সাথী-অনুগামীসহ তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবন দীপ্ত অংশগ্রহণকারী। 

মুসলিম লীগের কর্মী থাকার সময় থেকেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের সাথে তার অল্পবিস্তর পরিচয় ও কিছুটা ঘনিষ্ঠতার সূচনা ঘটে। তখন থেকেই তার মাঝে সংগোপনে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি অনুভুতি এবং অসাম্প্রদায়িক বোধের  উন্মেষের বীজ রোপিত হয়। 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতির ওপর পরিচালিত শোষণ-বঞ্চনা, বাংলা ভাষার ওপর আঘাত, প্রতিক্রিয়াশীল অংশের দ্বারা মুসলিম লীগের নেতত্ব করায়ত্ত হওয়া ইত্যাদি তাকে অতি দ্রুতই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মচারীদের দাবি নিয়ে সংগ্রাম করে তিনি জেলে যান। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ভাষানী-সারোওয়ার্দ্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন।  

ভাষা আন্দোলনের জাগরনের পটভুমিতে অনুষ্ঠিস '৫৪সালের নির্বাচনে 'যুক্তফ্রন্টের' অভূতপর্ব বিজয়ের পর ‘শেখ সাহেব’ দুইবার প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সারোওয়ার্দী 'স্বায়ত্বশাষন' ও 'সাম্রাজ্যবাদের' প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আওয়ামী লীগ ভেঙে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে 'ন্যাপ' গঠিত হয়। চলে নবগঠিত ন্যাপের ওপর আওয়ামী-হামলাবাজি। ‘শেখ সাহেবও’ ন্যাপের বিরুদ্ধে সারোওয়ার্দী সাহেবের পক্ষ নেন। তবে, ‘শেখ সাহেব’ অচিরেই বুঝতে সক্ষম হন যে, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু তার নেতা সারোওয়ার্দ্দী সাহেবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। তাই দেখা যায়, ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে এ্যাসেমব্লিতে ন্যাপ উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই ‘ন্যায্য’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানান। 

প্রগতিশীলদের সাথে তার নৈকট্য ক্রমে ক্রমে আরো বৃদ্ধি পায়। আইয়ুবী সামরিক শাসন জারির পর প্রবল নির্যাতন ও আক্রমণের মুখে ‘শেখ সাহেব’ কিছুদিন হতাশায় আচ্ছন্ন ছিলেন। ন্যাপের ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ তাকে উজ্জীবিত রাখতে সাহায্য করেন।  ’৬১-সালের শেষ দিকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, খোকা রায় প্রমুখের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠকে তিনি মিলিত হন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সূচনা করার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। ‘শেখ সাহেব’ একাধিকবার পার্টির নেতাদের বলেন যে, গণতন্ত্র, বন্দীমুক্তি প্রভৃতি দাবির সাথে সাথে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবিও তখনই উঠানো উচিত। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ‘স্বাধীনতার দাবিটি সঠিক বটে, তবে তা উত্থাপনের জন্য এখনো অবস্থা পরিপক্ব হয়নি। এখন গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে'। ‘শেখ সাহেব’ তার নেতা সারোওয়ার্দ্দী সাহেবের সাথেও কথা বলেন। শেষ বৈঠকের দিন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বলেন যে, ‘দাদা। আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, কিন্তু যুক্তিগুলো সব মানলাম না’।

দেশ-কাল-পাত্রের কাঠামো ও প্রেক্ষাপটে, এবং সমাজে তার শ্রেণিগত অবস্থানের আলোকেই, ইতিহাসে একজন ব্যক্তির ভূমিকার সম্ভাবনা ও সীমা নির্ধারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। কোনো মানুষই সর্বক্ষেত্রের ও সর্বকালের বিচারে সবধরনের দূর্বলতা সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত একেকটি বিমূর্ত বিশুদ্ধজন নয়। মানুষ ফেরেশতা নয়। কোনো মানুষের পক্ষেই সেরূপ হওয়া সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রই হলো ইতিহাসের ফসল। এটি ইতিহাসেরই কথা। 

রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে বলা যায়, শীর্ষ পর্যায়সহ যেকোনো পর্যায়ের নেতা বা কর্মীর ভূমিকা শেষ পর্যন্ত তার দলের চরিত্রের, এবং দলের চরিত্র তার শ্রেণি ভিত্তি দ্বারা নির্ধারিত গন্ডির বাইরে যেতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবর রহমানের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। মুসলিম লীগের ঝান্ডা নিয়ে ‘লড়কে লেংগে পাকিস্তান’ আন্দোলনের আবর্তে তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভাবধারা গ্রহণ করেন এবং নবগঠিত আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। পরবর্তী প্রায় তিন দশক ধরে তিনি সেই ধারার রাজনীতিই করেছেন। এক পর্যায়ে, বিশেষত: তাঁর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর, তিনি সেই দলটির একক শীর্ষ নেতা বা 'সুপ্রিমো' হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। 

আওয়ামী লীগ দলটির নীতিতে নানা সময় এদিক-ওদিক ঘটলেও তাঁর শ্রেণি ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর সময়কালে আগাগোড়াই ছিল বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া (এখন অবশ্য সেই দলটির ওপর লুটেরা ধনিক শ্রেণির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে)। বঙ্গবন্ধু নিজের শ্রেণি অবস্থানও ছিল সেরূপ। উদার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ভাবধারার পাশাপাশি তাঁর মাঝে উপস্থিত ছিল বুর্জোয়া রক্ষণশীলতা, ও এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গিরও কিছু উপাদান। দলের ও তার নিজের শ্রেণি ভিত্তির এই বৈশিষ্ট্যের গন্ডির মধ্যে থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন। তবে একথাও সত্য যে এই সীমার মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করতে স্বক্ষম হয়েছিলেন। ইতিহাস সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজনে কখনো কখনো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি সেই সীমা অতিক্রম করার চেষ্টাও করেছেন। এটিই ছিল তার শক্তির একটি অনন্য উপাদান।

ইতিহাসের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে হলে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। একথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল ৯ মাসের ‘সামরিক একশন’ ছিল না। তা ছিল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারায় দীর্ঘ দিনের গণসংগ্রামের ফসল। ৯ মাসের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল বহু বছর ধরে চলতে থাকা সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতার শীর্ষ অধ্যায়। বাঙালির এই সুদীর্ঘ জাতীয় আন্দোলনের প্রক্রিয়া প্রধানতঃ দু’টি মূল ধারায় বিকশিত হয়েছিল। একটি ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা ও অপরটি ছিল প্রগতিশীল বামপন্থী ধারা। কখনো প্রথম ধারাটিই ছিল প্রধান, আবার কখনো দ্বিতীয় ধারাটিই ছিল প্রধান। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বকালীন একটি বিশেষ সময়ে এই জাতীয়তাবাদী শক্তি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি পরিত্যাগ করেছিল। বামপন্থিদেরকেই তখন এককভাবে সেই দাবি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। 

কিন্তু, ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বামপন্থী শক্তির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হইয়েছিল এবং তারা রাজনৈতিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে কিছু গুরুতর ভুল করেছিল। ফলে তাদের ভূমিকা জাতীয়তাবাদী শক্তির তুলনায় পিছিয়ে পরেছিল। এদিকে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ‘সুপ্রিম লিডার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। বাংগালীর স্বাধীকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ৬-দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরেছিলেন। এই সময়টিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’ আসামী করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ৬-দফাকে ভিত্তি করে ঘটেনি। ঘটেছিল ১১-দফাকে ভিত্তি করে। এই ১১-দফায় ৬-দফার বিষয়গুলোর সাথে জনগণের রুটি-রুজির দাবি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাবি, প্রগতিশীল অর্থনৈতিক পদক্ষেপের দাবিসহ বামপন্থীদের র‍্যাডিক্যাল দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। এভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তি ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যের প্রশ্নে একটি নীতি-কর্মসূচিগত ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। 

দেশের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী এই দুটি সমান্তরাল স্রোতধারাসহ রাজনীতির প্রায় সবগুলো স্রোত এভাবে ক্রমেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মোহনায় এসে মিলিত হতে পেরেছিল। সেই সূত্রেই, বঙ্গবন্ধু ১১-দফার দাবিগুলোকে মেনে নিয়েছিলেন, এবং এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের একক নেতা হিসেবে তার উত্থান সম্ভবঙ্করে তুলেছিলেন। তাঁর এই একক নেতৃত্বের অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়েছিল সত্তরের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি আসনে ও পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার মধ্য দিয়ে। 

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-ধারা ও তার ভিত্তিতে আর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের যে সব ঐতিহাসিক অর্জন, বঙ্গবন্ধু পরিণত হয়েছিলেন তার প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দুতে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেকে বিতর্ক তোলার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু বিতর্ক করাটি কেবলমাত্র একটি অন-ঐতিহাসিক কাজ ও অর্থহীন পন্ডশ্রম হিসেবে গণ্য হতে পারে। কারণ, এ বিষয়ে বিরোধীতা বা সব সন্দেহ ও বিতর্কের অবসান বহুলাংশে ঘটে গেছে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ঘটনার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও ধারা থেকে সরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে হয়েছিল। এর কারণ ছিল এই যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দু ও প্রতীক।

বঙ্গবন্ধু কখনোই নিজেকে শ্রেণিচ্যুত এবং সর্বহারার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন বলে মনে করতেন না। আগাগোড়াই তিনি ছিলেন বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত একজন অনন্য সাধারণ জাতীয়তাবাদী নেতা। তাঁর ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ অর্জন করেছিল সুস্পষ্ট প্রগতিমুখীনতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাতের ফলশ্রুতিতেই তা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর সবটাই কি কেবলই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর ফলস্বরূপ সৃষ্ট ছিল? এই প্রগতিমুখীনতা অর্জনের পেছনে কি ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কোনো ভূমিকা ছিল না? 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসম্বাদিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সন্দেহাতীতভাবে প্রগতিশীল মর্মবাণী সম্পন্ন। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয় যে তা সম্ভব হওয়ার পেছনে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রভাব থাকলেও সে প্রভাবকে মূর্ত রূপ দেয়া কখনোই সম্ভব হতো না, যদি সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ভূমিকা ও অবদান না থাকতো। মুসলিম লীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে রিজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ি হলেও

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের জন্ম দিতে  বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সামিল হয়ে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। মওলানা ভাসানীর মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও মজলুমের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রবক্তা না হয়ে উঠতে পারলেও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল ও চিহ্নিত দক্ষিণপন্থী সিনিয়ার নেতাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে দলকে উদ্ধার করে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ধারায় নিজের নেতৃত্বে দলকে সংহত করতে তিনি সক্ষম হন। চলমান গণসংগ্রামের সবরকম স্রোতধারাকে ধারণ করে চলার কৌশল গ্রহণের ফলে ইতিহাসের ঠিক নির্ধারণমূলক সময়টিতে তিনি বাঙ্গালীর স্বাধীকার সংগ্রামের নেতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

যেহেতু বামপন্থা ছিল চলমান গণআন্দোলনের একটি প্রধান ধারা, তাই তার প্রভাবে জাতীয় আন্দোলনও প্রগতিমুখীন চরিত্র অর্জনের সম্ভাবনায় পুষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রমিক-কৃষকের ব্যাপক অংশগ্রহণ এই প্রগতিমুখীন সম্ভাবনাকে আরো বলিষ্ট করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও প্রগতিশীল বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করে। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আরব রাষ্ট্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এসবের ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রগিতমুখীনতা অনিবার্য হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু সেই প্রগতির ধারাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার পথে নিজেকে সামিল করেন। নিজস্ব ধারা ও কৌশলে তিনি জাতিকে সেই পথে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করেন। 

বঙ্গবন্ধুর সেই নিজস্ব ধারা ও কৌশলে পাশাপাশি বিরাজমান ছিল একাধারে বঙ্গবন্ধুর ‘জনগণ মন অধিনায়কোচিত’ প্রবণতার ও অন্যদিকে তার শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। প্রতীকীভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর অর্ধেকটা মন জুড়ে ছিল মজলুম জননেতা ভাসানী (তার সাথে যুক্ত হয় কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ) আর বাকি অর্ধেকটা দখল করে ছিল গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলে কথিত উদারনৈতিক বুর্জোয়া নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। হৃদয় ও অনুভূতির টান একদিকে, আর বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণিভিত্তির টান আরেক দিকে। একদিক থেকে প্রভাব মজলুম জনতার, অন্যদিক থেকে প্রভাব বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ ও তাদের লক্ষ্য-আদর্শ-ভাবধারার। একদিকে শ্রমিক শ্রেণিসহ সমগ্র জনগণের কল্যাণ সাধনের আন্তরিক বাসনা, অন্যদিকে বুর্জোয়া রক্ষণশীলতা ও কিছু সামন্তবাদী পশ্চাদপদতা। দু’দিকের শক্তি তাঁকে আগাগোড়াই ভিন্ন ভিন্ন পথে যেতে প্ররোচিত করেছে। এই দোটানা নিয়েই বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙ্গালি জাতিকে।

আদর্শগতভাবে যথাযথ প্রস্তুতিহীন একটি বড় অংশের মানুষকে 'পয়েন্ট অফ নো রিটার্ণে' নিয়ে গিয়ে ঘটনাচক্রে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামিল করার কৌশলও তিনি গ্রহণ করেন। এভাবে চেতনার নানা স্তরের মানুষকে নিয়ে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে বঙ্গবন্ধু সমর্থ হন। শ্রেণি স্বার্থের প্রশ্নেও তিনি শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া সকলেের আকাংক্ষ্যাগুলোকে একই সাথে সমর্থন করার কথা বলতে থাকেন। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন 'সকল বাঙ্গালীর' নেতা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের এসব যাবতীয় শক্তি ও দুর্বলতার প্রতিচ্ছায়া ছিলেন ‘ব্যক্তি মুজিব’। সে কারণেই ইতিহাসের বিশেষ নির্ধারণমূলক কালে, তথা একাত্তরের পূর্বক্ষণে তিনি জাতির স্বাভাবিক নেতা হিসেবে নিজের স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। 

এ ধরনের অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে ইতিহাস সৃষ্টি করা সম্ভব হলেও সেই কাঠামোকে ধরে রেখে সরকার পরিচালনা ও রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর হিসেবে বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেও সেই সাময়িক জাতীয় ঐক্য অব্যাহত রাখতে পারেন নি। তা করতে পারা সম্ভবও ছিল না।  তিনি সব পক্ষকে খুশি রেখে চলতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে সব পক্ষই বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মার্কসবাদী ছিলেন না। শ্রেণি স্বার্থ কিভাবে তার সংহার শক্তি নিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মাঠে নামে, তা বঙ্গবন্ধু অনুমান করতে পারেন নি। '৭৫-এর আগস্টের শুরুতে তাঁর জীবনের ওপর সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক করতে যাওয়া কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদেরকে তিনি ' কোন বাংগালী আমাকে গুলি করতে পারবেনা, গুলি করতে গেলে তার হাত কেঁপে যাবে' বলে আশ্বস্থ করেছিলেন। আটি ছিল তার প্রানঘাতি ভ্রান্তি। তিঁনি 'বাংগালী' বিষয়টিকে বুঝ্লেও 'শ্রেণির' বিষয়টিকে বুঝে উঠতে পারেননি। 

একাত্তরের সফল মুক্তিযুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যবাদ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তার আঁতে ঘা লেগেছিল মারাত্মকভাবে। সে অপেক্ষা করে বসেছিল প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। শত্রুর বর্বরতার মাত্রা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধির অভাব ও তা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাবের সুযোগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক দলের সহায়তায় সাম্রাজ্যবাদ আঘাত হেনেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান রচনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই হয়ে আছে ও তা থাকবে চিরকাল। ইতিহাসের এই অমোচনীয় আখ্যানের কথা বিবেচনা করেই হয়তো কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু লিখেছেন - 

‘যতোই হোক না সময় ও কাল বন্ধা

মুজিবের জন্য নষ্ট হবে না হৃদয়ের রজনীগন্ধা।’

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন