বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ৩ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তী ও ইতিহাসের কণ্ঠস্বর

আবুল খায়ের ২১ অক্টোবর , ২০২৩, ১৭:৩৩:৪৩

477
  • রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তী ও ইতিহাসের কণ্ঠস্বর

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট সংক্ষেপে বিএলএফ তথা মুজিববাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য জননেতা তোফায়েল আহমেদের ৮০তম শুভ জন্মবার্ষিকী ও ৮১তম শুভ জন্মদিনে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও সংগ্রামী শুভেচ্ছা। নির্ভীক এই রাজনীতিক দেশসেবা তথা রাজনীতিকে জীবনে চূড়ান্ত প্রাধান্য দিয়েছেন। দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং অপার দেশপ্রেমকে পাথেয় করেই তিনি এগিয়েছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনে সংগ্রামী নেতা তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর ভোলা জিলার কোড়ালিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজহার আলী ও মাতা ফাতেমা খানম। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ও অনলবর্ষী বক্তা তোফায়েল আহমেদ ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ডাকসু’র ভিপি থাকাকালে ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা কর্মসূচী হুবহু ১১ দফায় অন্তর্ভূক্ত করে ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। ’৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ মাস কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ‘আগরতলা মামলা’য় আটক সকল রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে তার নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় তৃণমূল পর্যন্ত তুমুল গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন।

’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তিদানে স্বৈরশাসককে বাধ্য করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়েঅজিত গণসংবর্ধনা সভার সভাপতি হিসেবে ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞ চিত্তে জাতির জনককে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর ’৬৯-এর ২৫ মার্চের মধ্যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে গৌরবের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল।

’৬৯-এ তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং’ ৭০-এর ২ জুন (সোমবার), জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব প্রদান করায় তিনি দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করেন। আবাসিক হল ও ডাকসুর ভিপি থাকাকালে তিনি জাতির জনকের একান্ত সাহচর্যে আসেন। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোলার দৌলত খাঁ-তজুমদ্দিন-মনপুরা আসন থেকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনি অন্যতম সংগঠক এবং ‘মুজিব বাহিনী’র অঞ্চল ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন। বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া ও পাবনা সমন্বয়ে গঠিত মুজিব বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল (মঙ্গলবার) ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ ও ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের তিনি অন্যতম সংগঠক এবং ’৭২-এর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও বলবৎকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।

’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন; দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন।

 ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৭৩-এ নিজ জেলা ভোলা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী’ নিযুক্ত হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর বিশ^স্ত অনুসারী হিসেবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী হন।

’৭২-এর ৬ ফেব্রæয়ারি ১ দিনের সফরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা এবং একই বছরের ১ মার্চ ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো গমন করেন। ’৭৩-এর ২৬ জুলাই প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রোজ টিটোর আমন্ত্রণে যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড এবং যুগোস্লাভিয়া থেকে ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান। একই বছরের ১৭ অক্টোবর ৭ দিনের সফরে জাপানের রাজধানী টোকিও সফর করেন। ১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং ২৩ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। ওই বছরেই ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেন; ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হিসেবে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন; ৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ সফর করেন।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাঁকে প্রথমে গৃহবন্দি ও পরে পুলিশ কন্ট্রোল রুম এবং রেডিও অফিসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তাঁকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়। পরে কুষ্টিয়া কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

দীর্ঘ ৩৩ মাস তিনি কারান্তরালে ছিলেন। ’৭৮-এ কুষ্টিয়া কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। জাতীয় রাজনীতির চরম দুঃসময়ে দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি সফলভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার আমলে তাঁর আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়; হাইকোর্ট তাঁকে জামিন প্রদান করলেও স্বৈরশাসক তাঁকে মুক্তি দেয়নি।

তখন সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে দীর্ঘ ৩৩ মাসের বন্দিদশা থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন মেয়াদে ৪ বার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ’৮২-এর ২৪ জানুয়ারি সামরিক শাসন জারির পর ২৬ জানুয়ারি সাভারে গ্রেপ্তার করা হয়। ’৮৩-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে প্রথমে সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরে, পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তারপর সিলেট কারাগারে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়। ’৮৪তে ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও পরে কুমিল্লা কারাগারে আটক রাখা হয়। ’৮৭তে ভোলায় গ্রেপ্তার করে বরিশাল কারাগারে আটক রাখা হয়। ’৯৫-৯৬-এ ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এর অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তাতে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাজশাহী কারাগারে আটক রাখা হয়। ২০০২-এ খালেদা-নিজামী জোট সরকারের শাসনামলে সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট থানায় পরে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির আসামীর কনডেম সেলে ১২ দিন আটক রেখে সেখান থেকে কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠানো হয়। রাজনৈতিক জীবনে সর্বমোট ৭ বার তিনি দেশের বিভিন্ন কারাগারে-ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা ও সিলেট-অন্তরীণ ছিলেন। এর মধ্যে সর্বমোট ৩ বার তাঁকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখা হয়।

’৭০-এ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ (পরে বাংলাদেশ গণপরিষদ), ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮-এর সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সর্বমোট ৮ বার তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ’৯১ ও ’৯৬-এর নির্বাচনে ভোলা-১ ও ভোলা-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে ’৯১-এর জাতীয় সংসদে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ পুনঃপ্রবর্তনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ’৯২তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘ ১৮ বছর এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ’৯৬-এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গণরায়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্যমতের সরকারে’ তিনি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে দেশ-বিদেশে রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। দু’বার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মিনিস্টারিয়েল কনফারেন্সে যথাক্রমে সিঙ্গাপুরে প্রথম, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় দ্বিতীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে তৃতীয়, কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে চতুর্থ ও আর্জোন্টিনার রাজধানী বুয়েনস্ আয়ার্সে পঞ্চমবারের মতো যোগদান করে স্বল্পোন্নত দেশের মুখপাত্র ও সমন্বয়কের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন এবং বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশের পণ্য উন্নত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের অঙ্গীকার আদায় করেন।

এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা এসক্যাপ ও ফাও-এর মিটিংয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর জোরালো ভূমিকার কারণে বিশ্বে স্বদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ ইয়েমেন, ইরাক, মিসর, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, অস্ট্রেলিয়া, বাহামা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেন।

২০০১-এর ১ অক্টোবরের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ষাড়যন্ত্রিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অনুকূলে প্রাপ্ত নির্বাচনি রায় ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ নির্বাচনের পর দেশব্যাপী খালেদা-নিজামীর সরকার সংখ্যালঘু জনসাধারণসহ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার-নির্যাতন করে। বিশেষ করে ভোলায় এই নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ! এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন এবং চার দলীয় জোট ও ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিরোধী আন্দোলনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

২০০৭-এ এক-এগারো’র পরের দুঃসময়ে তাঁকে স্ত্রী-কন্যাসহ মিথ্যা মামলার আসামী করা হয়। কিন্তু তবু তিনি অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করে দলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) পাশে থেকেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘জীবন দেবো, তবু বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করব না।’ ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০-এ তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা কল্পে ২০১৪’র ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পাদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকারে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সেই নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং নবগঠিত সরকারে সাফল্যের সাথে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি ভোলা-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে পুননির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পবিত্র সংবিধান থেকে কলঙ্কিত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ অপসারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তাঁর ভূমিকা অগ্রগণ্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে অদ্যাবধি তিনি রাজপথে ও জাতীয় সংসদে জনস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তৃতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। আওয়ামী লীগ দলীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে ’৮৬ ও ’৯১-এর জাতীয় সংসদে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে তাঁকে বিস্তর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরমতসহিষ্ণুতা ও অপরিসীম ধৈর্য ধারণ করে সে-সব বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে ‘কার্যপ্রণালি বিধি’ অনুযায়ী সংসদীয় ভাষায় বক্তব্যাদি পেশ করেছেন। বক্তৃতমালায় কিছু স্থানে  স্পিকারের হস্তক্ষেপ প্রাসঙ্গিকতায় ঠাঁই পেয়েছে।

’৯১-এর পার্লামেন্টের শেষের দিকে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষেদোক্তি প্রকাশ করে প্রবল প্রতিবাদে স্পিকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘মিস্টার স্পিকার, এই পার্লামেন্টে আমি একদিনও ‘ইন্টারফিয়ারান্স’ ছাড়া কথা বলতে পারি নাই।’ তাঁর বক্তৃতায় বারংবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে-মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব; যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির জনকের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা; ’৭৫-এর পর অবৈধ-অসাংবিধানিক স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ও তেজস্বী অবস্থান; এবং এসব বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের কণ্ঠস্বর, তাঁর বক্তব্য হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক।

বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী তোফায়েল আহমেদের মাতৃভক্তি অনুসরণীয়। ভোলা জেলার বাংলা বাজারে তাঁর মায়ের নামে তিনি স্থাপন করেছেন ‘ফাতেমা খানম কমপ্লেক্স’। সেখানে স্থাপিত হয়েছে, ফাতেমা খানম গার্লস হাই স্কুল; ফাতেমা খানম ডিগ্রি কলেজ; ফাতেমা খানম মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র; ফাতেমা খানম শিশু পরিবার; ফাতেমা খানম জামে মসজিদ; ফাতেমা খানম বৃদ্ধাশ্রম; এখন নির্মাণ কাজ চলছে আজহার-ফাতেমা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নবীন প্রজন্মের নিকট সমুন্নত রাখতে এই কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠা করেছেন দৃষ্টিনন্দন ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’।

যে জাদুঘরে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ও ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় দেয়ালগাত্রে সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বের বহুবিধ আলোকচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও দলিলপত্রাদি। যাতে প্রতিফলিত হয়েছে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, মহান ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন, ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলায় জাতির জনকের নেতৃত্বে বীর বাঙালির ভূমিকা। আরও আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকার প্রধান ও বরেণ্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দুর্লভ সব স্থির ও প্রামাণ্য চিত্র।

এক কথায় বলতে গেলে, নবপ্রজন্মের যে কেউ জাদুঘরটি পরিদর্শন করলে তার ইতিহাস দর্শন হবে সুনিশ্চিত। ভোলা জেলার বাংলা বাজার পরিদর্শনরত দর্শনার্থীরা মনে করেন তাঁর স্থাপিত এই কমপ্লেক্সটির কারণেই এটি একটি সুন্দর শহরে পরিণত হয়েছে।

প্রায় তেষট্টি বছরের রাজনৈতিক জীবনে হামলা-মামলা ও কারানির্যাতন ভোগ করা সত্বেও একই আদর্শে ও দলে ধারাবাহিকভাবে স্বীয় অবস্থান সমুন্নত রেখে ‘রাজনৈতিক ইন্টিগ্রিটি’ বজায় রাখার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। অনাগত দিনে স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ দেশের চরম দুঃসময়ের কালপর্বে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীদের নিকট দুঃসাহসের প্রতীক। আমরা দেশবরেণ্য এই সংগ্রামী নেতার নীরোগ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন