রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯ , ১১ রমজান ১৪৪৪

ফিচার
  >
বিশেষ কলাম

আর কত ফেলানী চাও!

সৈয়দ মুহাম্মদ আজম ৭ জানুয়ারি , ২০২৩, ১১:৫২:৪৩

334
  • আর কত ফেলানী চাও!

নতুন বছরের শুরুটা হয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে এক বাংলাদেশির মৃত্যুর মাধ্যমে। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্ত প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিদের রক্তে রঙিত হচ্ছে। তবে আশ্চর্যে বিষয়, ভারতের সঙ্গে চীন, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও গত ১৫ বছরে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নিহতের ঘটনা ঘটেনি। মরেছে শুধু বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকরা। এর জবাব চাওয়া হলে বলা হয় যে তারা অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছে কিংবা চোরাচালান করার সময় বিএসএফের গুলিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

সীমান্তে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনাকে বিএসএফ ‘হত্যা’ না বলে ‘অনাকাঙ্খিত’ ঘটনা বলছে। তারা এর দায়ভার নিতে রাজি নয়। অনাকাঙ্খিত ঘটনা দু-একবার হয়, যখন রুটিন করে ঘটনার জন্ম দেয়া হয় তখন সেটা আর অনাকাঙ্খিত থাকে না, ইচ্ছাকৃত হয়ে যায়। এই নরমাল টার্মটাই বোধহয় তাদের মগজে খেলে না। 

ভারতের সাথে বাংলাদেশ সৃষ্টির বহু পুরোনো সম্পর্ক। জন্মলগ্ন থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও বজায় রয়েছে। শুধু মাঝে কাঁটাতারের বেড়া। যেটা কি না উভয় দেশকে একটা নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। যাকে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে মানচিত্রে চিত্রায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এই সীমারেখা দু’দেশের মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেনি; এখনও সীমান্তে উভয় দেশের মানুষের মিলনমেলা বসে, আসা-যাওয়া হয়, ভাবের আদান-প্রদান হয়। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলার প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপ।

উভয় দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের বুক ঝাঁঝড়া হচ্ছে, সীমান্তে সন্তান হারিয়ে মায়ের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়। উভয় দেশের নেতাদের বৈঠকে বারবার সীমান্ত হত্যা আলোচনার বিষয় হলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হয়নি। বন্ধ হয়নি সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে ২০১৮ সাল থেকে গত পাঁচ বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ১৪৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা অধিকারের দেয়া এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে গত দশ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৩৩৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে ৫১ জনকেই হত্যা করা হয়েছে ২০২০ সালে।

২০১৮ ও ২০১৯ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ১৪ ও ৩৮ জন বাংলাদেশি। ২০২০ সালের শুরুর ২৩ দিনেই সীমান্তে অন্তত ১৫ জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা মাসুম ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিএসএফ’র হাতে ১০৫টি হত্যার তদন্ত করেছে। তারা বলছে যে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। 

গত বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত হত্যা জিরো দেখতে চেয়েছিলেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশ সরকার-ভারত সরকার দুই সরকারই বারবার অঙ্গীকার করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি লোকও আমাদের সীমান্তে মারা যাক আমরা চাই না। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘটনা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে আমরা সীমান্তে ২১ জনের নিথর দেহ দেখেছি।

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএফের ভয়ঙ্কর নির্মমতার শিকার হয়েছিল কিশোরী ফেলানী খাতুন। তার হত্যার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখন বিচার পায়নি পরিবার। সন্তান হারার বিচারের আশায় এখনো কাঁদে তার বাবা-মা। তার কবরের পাশে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের বর্বতার ভয়াল দৃশ্য। কাঁটাতারে ঝুলছে সন্তানের লাশ! গুলিবিদ্ধ ফেলানী মৃত্যুর আগ মুর্হূতে পানি পানি করে চিৎকার করেছিল, পানি পানের সুযোগ পায়নি। ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে তার মরদেহ।

ফেলানীর মৃত্যুর প্রায় দুই বছর পর ভারতে কোচবিহারের এক আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। কিন্তু  বিএসএফের বিশেষ আদালত আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেয়। সেই রায় প্রত্যাখ্যান করে পুনঃবিচারের দাবি জানায় ফেলানীর বাবা। এবারো আদালত আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়। ২০১৫ সালে ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রীম কোর্টে রিট পিটিশন করলে নানান নাটকীয়তায় থমকে যায় রিট শুনানি।

প্রতিনিয়ত সীমান্তে বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু বন্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যদিও উভয় দেশের বৈঠকে আলোচনার বিষয় হয়েছে কিন্তু সমাধানে প্রতিবেশী দেশের ওপর কার্যকরী কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। সীমান্তহত্যা বন্ধে সরকার ভারতের ওপর চাপ তৈরি করতে না পারলে এই মৃত্যু মিছিল বন্ধ হবে না। সীমান্ত নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। 

এক্ষেত্রে ভারতকেও সহানুভূতিশীল ও বন্ধুসূলভ আচরণ করতে হবে। বারবার অঙ্গীকার করেও তারা মৃত্যুর মহোৎসব থেকে সরে দাঁড়াতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে তারা বোধহয় পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে। বাংলাদেশকে এবার শক্তবাক্যে এবং পরিষ্কারভাবে বলতে হবে, আর কত ফেলানী চাও?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, smajom.2001@gmail.com

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন