শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ , ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার
  >
বিচিত্র

১০ হাজার ফুট উপর থেকে পড়েন আমাজনের জঙ্গলে

নিউজজি ডেস্ক ১২ ফেব্রুয়ারি , ২০২২, ১৬:০৭:২৫

374
  • ইন্টারনেট থেকে

বাঁচার শেষ চেষ্টা? না কি অসম্ভব মেনে হাল ছেড়ে দেওয়া? সদ্য স্কুল পেরনো পেরুর এক কিশোরী অসম্ভব বুঝেও প্রথমটিই বেছে নেন। বানভাসি হয়েও খড়কুটো ধরে যেমন বাঁচতে চায় মানুষ। নাম জুলিয়েন কোপকে। এক অদ্ভুত বিমান দুর্ঘটনার শিকার জুলিয়েন প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে বিমান ভেঙে নিচে পড়ে যান। তবে তারপরেও তিনি বেঁচে যান।

এমন মিরাকেলের সামনে পড়েও অবশ্য অবাক হওয়ার অবকাশ পাননি জুলিয়েন। কারণ প্লেন ভেঙে তিনি পড়েন আমাজনের গভীর জঙ্গলে। এক বিপদ থেকে মূর্তিমান আরএক বিপদের মুখে। জনবিবর্জিত এবং বিপদসঙ্কুল আমাজনের জঙ্গলে সম্পূর্ণ একা! জুলিয়েন ভাবতে পারেননি সেখান থেকে বেঁচে ‘সভ্য’ জগতে ফেরা সম্ভব হবে। তবু হাল না ছেড়ে চেষ্টা করে গিয়েছেন।

প্লেন থেকে পড়ে যাওয়ায় কলার বোন ভেঙে যায়, চোট লাগে হাতে পায়ে। খুবলে যায় শরীরে বেশ কয়েকটি জায়গা। ওই অবস্থায় অ্যামাজনের জঙ্গলে কাদার মধ্যে টানা দু’দিন পড়েছিলেন জুলিয়েন। জ্ঞান ফিরলে পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই গোটা একটা দিন লেগে যায় তার। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ১৯৭১ সাল। বড়দিনের আগের সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে জুলিয়েন ফিরছিলেন পেরুর পাঙ্গুয়ানার নিজের বাড়িতে। পড়াশোনার জন্য পেরুরই অন্য একটি শহর, লিমায় থাকতেন জুলিয়েন।

বাবা-মা দু’জনেই প্রাণীবিজ্ঞানী। পাঙ্গুয়ানার বাড়িটি ছিল আদতে ছোটখাট গবেষণাগার। জঙ্গলে তারা বাড়িটি করেন গবেষণার সুবিধার জন্যই। বাড়ি ফেরার জন্য সেদিন প্রথম থেকেই তাড়াহুড়ো করেন জুলিয়েন। এদিকে একের পর গোলমালও হয়েই চলে। এক ঘণ্টার উড়ান। অথচ সেই বিমান রওনা হতেই দেরি হয়ে যায় ৭ ঘণ্টা।

২৪ ডিসেম্বর দুপুরের কিছু আগে আকাশে ওড়ে জুলিয়েনদের বিমান। লানসা ফ্লাইট নম্বর ৫০৮। তবে ওড়ার ২৫ মিনিট পরই আবার শুরু হয় গোলমাল। হঠাৎই প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়ে বিমানটি। মারাত্মক ঝাঁকুনি দিতে শুরু করে। ঝাঁকুনির দমকে খুলে যায় প্লেনের জিনিসপত্র রাখার জায়গা। যাত্রীদের অনেকেই ক্রিসমাসের উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বড়দিনের আগেই সেই উপহারের বৃষ্টি শুরু হয় বিমানের ভিতর যাত্রীদের মাথার উপরে। চাইলে তখনও ঘুরিয়ে নেওয়া যেত বিমান। কিন্তু বিমান সংস্থার উপরেও সম্ভবত উৎসবের চাহিদা মেটানোর চাপ ছিল। তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিমানটি তার যাত্রাপথে এগোতে থাকে।

আর ঠিক ১০ মিনিট পরে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। বিদ্যুতের একটা ঝলক দেখা যায় বিমানের বামদিকের ডানায়। জুলিয়েন তার মাকে চিৎকার করে বলতে শোনে— ‘‘ব্যাস এটাই শেষ। সব শেষ হয়ে গেল।’’ তারপরই ওই বিমান ডিগবাজি খেয়ে নাকবরাবর সজোরে নিচে নামতে শুরু করে। জুলিয়েনের এরপর আর কিছু মনে নেই। শেষমুহূর্তে শুধু ইঞ্জিনের প্রবল আওয়াজ, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর চারপাশে আতঙ্কের চিৎকারের কথা মনে আছে তাঁর। আর মনে আছে একটা দৃশ্য ঘন জঙ্গল ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছে।

পরের দিন জ্ঞান ফেরে জুলিয়েনের। ঝড়ে যাওয়া পাতার পুরু চাদরের উপর পড়ে তার যন্ত্রণায় কাঁটা হয়ে থাকা শরীরটা। ২১ হাজার ফুট উচ্চতায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় তার বিমান ১০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ভেঙে পড়ে। সেখান থেকে জঙ্গলের পাতার বিছানায় এসে পড়ে সদ্য স্কুল পেরনো কিশোরী।

তবে তারপরও আঘাত লেগেছে। কলার বোন ভেঙে যায় জুলিয়েনের, মুচড়ে যায় হাঁটু। কাঁধে, পায়ে ছিল গভীর ক্ষত। আহত অবস্থায় জ্ঞান ফিরলেও উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না। আরও একটা দিন, আরও একটা রাত ওই ভাবেই পাতার বিছানায় শুয়ে প্রায় অচেতন হয়েই কেটে যায় তার। পরে সেই অভিজ্ঞতার কথা জুলিয়েন জানাবেন তার জীবনকাহিনীতে। লিখবেন, ‘সারা শরীর ভিজে। কাদায়-নোংরায় মাখামাখি। হয়তো দুর্ঘটনার পরে দিন-রাত বৃষ্টি হয়। পাতার বিছানায় মায়ের গর্ভে থাকা ভ্রুণের মতোই নিশ্চিন্তে শুয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরও। আরও ২৪ ঘণ্টা।’

ডিসেম্বর মাস। তারওপর বৃষ্টি। খোলা আকাশ। শীতবোধ সম্ভবত চলে যায় জুলিয়েনের। না হলে ভিজে পোশাকে ওই ঠাণ্ডায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। তার উপর জুলিয়েনের কাছে খাবার ছিল না। বৃষ্টি হওয়ায় আগুন জ্বালার শুকনো ডালও ছিল না। ছোট থেকেই জঙ্গলে বড় হয়েছেন। বাবা তাকে শিখিয়েছেন জঙ্গলে পথ হারালে কী ভাবে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। জুলিয়ন লিখেছেন, ‘বাবা বলেছেন, জঙ্গলে হারালে সবসময় নদীর খোঁজ করতে। নদীই রাস্তা দেখাবে। ছোটবেলার সেই শিক্ষা কাজে লাগে। জঙ্গলের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারি পাঙ্গুয়ানার জঙ্গলেই রয়েছি। একটা লাঠি নিয়ে রাস্তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ি।’

প্রথমেই মায়ের খোঁজ করেন জুলিয়েন। কিন্তু তার আশপাশে প্লেনের চিহ্নমাত্র দেখতে পান না তিনি। বেশ কয়েক মাইল হাঁটার পর কিছু ক্রিসমাসের উপহার চোখে পড়ে, বাক্সে ভরা কেক এবং মিষ্টিও। তবে মাকে খুঁজে পাননি। পরে জানতে পেরেছিলেন, ওই দুর্ঘটনায় তিনিই ছিলেন একমাত্র জীবিত বিমানযাত্রী। নদীর খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে এক’টি ঝর্ণার উৎসস্থল খুঁজে পান জুলিয়েন। সেটি অনুসরণ করে হাঁটতে থাকেন। নদীর খোঁজও পান। প্রায় ৭ দিন সেই নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে এক সময় নদী চওড়া হতে শুরু করে। আরও একদিন হাঁটার পর চোখে পড়ে বসতি। নদীর পাড়ে বাঁধা একটি নৌকাও দেখতে পান জুলিয়েন। তার পাশেই ছিল একটা কুঁড়ে ঘর।

ততদিনে জখম শরীর টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন জুলিয়েন। ক্ষতে তৈরি হয়েছে ঘা। পোকা ধরেছে তাতে। মুচকে যাওয়া পা-ও আর টানতে পারছেন না। কুঁড়েঘর দেখে জোর পান জুলিয়েন। আর প্রথমেই নিজের ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করেন। নিজের বইয়ে জুলিয়েন জানিয়েছেন, ছোটবেলায় দেখেছেন, ক্ষত সারাতে কেরোসিন ব্যবহার করতেন বাবা। জুলিয়েন নৌকায় গ্যাসোলিন পান। সেই তেলই ঢালেন ক্ষতস্থানে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষতস্থান থেকে পরজীবী পোকা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। নিজে হাতে অন্তত ২০-২৫টি এমন পোকা টেনে বের করেন সেদিন। তারপর জ্ঞান হারান।

ওই কুঁড়ে ঘর থেকে তাকে পরের দিন উদ্ধার করে স্থানীয় জেলেরা। প্লেনে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হন শহরের হাসপাতালে। ধীরে ধীরে সুস্থ হন জুলিয়েন। তবে ওই ১১দিনের ওই অভিজ্ঞতায় জীবনটাই বদলে যায় তার। জুলিয়েন এরপর বাবা মায়ের মতোই প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। পাঙ্গুয়ানার জঙ্গলেই তৈরি করেন গবেষণাগার। পরে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একটি বই লেখেন। নাম ‘হোয়েন আই ফেল ফ্রম স্কাই’। তবে জুলিয়েনের এই ১১ দিনের সফর শুধু বইয়ে নয় সিনেমার গল্প হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে। ইতালীয় ভাষায় তৈরি সেই সিনেমার নাম ‘মিরাকেল স্টিল হ্যাপেন্স’। অর্থাৎ আজও অলৌকিক ঘটনা ঘটে।

নিউজজি/এসজেড

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন