শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ১১ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

ভারতীয় চিকিৎসক ও অধ্যাপক ডা মহেন্দ্রলাল সরকার

নিউজজি ডেস্ক নভেম্বর ২, ২০২৪, ১২:২৭:০৯

74
  • সংগৃহীত

ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার 'সি আই ই' বাংলায় তথা ভারতে নতুন যুগের এক সমাজ সচেতন, জাতীয়তাবাদী ও মুক্তবুদ্ধির অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তার দৃঢ় চিত্ততা এবং প্রচেষ্টায় ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা ও চর্চার পথ সুগম হয়েছিল। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সাইন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন।

তিনি ১৮৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করে ভারতে বিজ্ঞান প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার পরামর্শে সরকারি প্রণয়নে মেয়েদের বিবাহের বয়স ন্যূনপক্ষে ১৬ বছর নির্ধারণ করেছিলেন। ১৮৮৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে অসমের চা শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্বন্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। মহেন্দ্রলাল শ্রমিকদের অপমানসূচক 'কুলি' শব্দ ব্যবহারে আপত্তি করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, কলকাতার শেরিফ এবং বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন।

মহেন্দ্রলাল সরকার ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা নভেম্বর কলকাতার কাছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত হাওড়া জেলার পাইকপাড়া(মুন্সিরহাট) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম তারকনাথ সরকার। খুব ছোট বয়সে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। শিশুপুত্রকে নিয়ে তার মাতা অঘোরমণি আশ্রয় নেন কলকাতার নেবুতলায় পৈতৃক বাড়িতে। তিন বছর পর তার মাও কলেরায় মারা যান।

অনাথ বালক মহেন্দ্রনাথের লালন পালনের দায়িত্ব নেন তা দুই মামা ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও মহেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ। তার শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় পাঠশালায়। ইংরাজী শেখানোর জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন গৃহশিক্ষক ঠাকুরদাস। অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন মহেন্দ্রলাল আর গৃহশিক্ষকের প্রতি ছিল তার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে তার মামারা যুগোপযোগী ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন।

ইংরেজিতে জ্ঞান লাভ করার সুবাদেই তিনি ১৮৪০ সালে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল ছিলেন মহেন্দ্রলাল। অদম্য কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা তাঁকে নতুন নতুন বিষয়ে আগ্রহী করে তুলত। স্বভাবতই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রবল। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন হিন্দু কলেজে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ না থাকায় তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়ার জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।

মেডিকেল কলেজে পাঠরত অবস্থায় তার জ্ঞানের উৎকর্ষ এতোটাই প্রতিভাত হয়েছিল যে তাকে দ্বিতীয় বর্ষে ছাত্রছাত্রীদের একাধিক বক্তৃতা দিতে আহ্বান করেছিলেন অধ্যাপকরা। কলেজ জীবনে তিনি অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে মেডিসিন, শল্যচিকিৎসা ও ধাত্রীবিদ্যায় অনার্স সহ এল এম এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার আগে ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ডা চন্দ্রকুমার দে এম ডি উপাধি পেয়েছিলেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি এবং জগৎবন্ধু বসু ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি।

মেডিকেল শিক্ষা সমাপ্ত করে মহেন্দ্রলাল স্বাধীন ভাবে চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতার দ্বিতীয় এমডি হিসাবে সুচিকিৎসার গুণে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসা জগতে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। কলকাতায় বৃটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের শাখা গঠিত হলে তিনি প্রথমে সেক্রেটারি ও পরে সহ-সভাপতি হন। তিনি প্রথমদিকে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার গুণাগুণ সম্পর্কে যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য অবশ্যই রাখতেন।

কিন্তু তৎকালীন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দেখে এবং অন্য দিকে মর্গ্যান রচিত ফিলজফি অব হোমিওপ্যাথি পড়ে, তখনকার খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথ বিশেষজ্ঞ, বিখ্যাত অক্রুর দত্ত পরিবারের রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্তের চিকিৎসা পদ্ধতি ও ফলাফল স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে তিনি ক্রমশ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ধারায় আগ্রহী হন।

প্রথমদিকে সফল না হলেও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রীতিতে তার কর্মজীবনে সফলতা আসে। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চতুর্থ বার্ষিক সভায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীর সর্বজননিন্দিত কতকগুলি দোষ কীর্তন করে হ্যানিম্যানের আবিষ্কৃত প্রণালীর যুক্তিযুক্ততা প্রদর্শন করে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রকাশ্য সভায় মহেন্দ্রলালের দৃঢ় মতামত শোনার পর উপস্থিত শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় ডাক্তারের বিরাগভাজন হন।

অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁকে বহিষ্কৃত করা হয় এবং সেই সঙ্গে একঘরে করার মতো অত্যাচার ও অপপ্রচার চলে। কিন্তু তিনি কোন কিছুতেই না দমে, সকল বিরুদ্ধতা বিপক্ষে নিজের সত্য মত প্রকাশের উদ্দেশ্যে এক বছরের মধ্যেই, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন। এই সময় তার ভূতপূর্ব অনেক অধ্যাপক তার প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সত্যের প্রতিষ্ঠায় তিনি অবিচল ছিলেন। তিনি তার এই অবস্থান ঘোর পরীক্ষা বলে উল্লেখ করেছিলেন-

সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী জেনে তিনি নিজের বিশ্বাসে স্থির ও অটল ছিলেন। তার ভূতপূর্ব অধ্যাপকদেরও অশ্রদ্ধেয় উক্তি করেন নি। উল্লেখযোগ্য যে,সে সময়ে মহেন্দ্রলাল সর্বশ্রেষ্ঠ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সম্মান ও গৌরব লাভ করেছিলেন। আজীবন হোমিওপ্যাথিক প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। তার এই কাজে অবশ্য রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।

দেশবাসীকে বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত ও সুযোগদানের উদ্দেশ্যে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯ শে জুলাই কলকাতায় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। প্রতিষ্ঠার ছয় বৎসর আগেই ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় জনগণের সহযোগিতা প্রার্থনা করে প্রচারপত্র প্রকাশ করেছিলেন। দেশের জ্ঞানীগুণী ধনী অনেকেই তার এই মহাকাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন- উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজা দিগম্বর মিত্র প্রমুখেরা। যে পরিচালন সমিতি গঠিত হয়েছিল তাতে দেশ হিতৈষীরা যুক্ত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ মিত্র, রমেশ চন্দ্র মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আমৃত্যু ডা সরকার প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক ছিলেন।

ডা. সরকারের পরামর্শে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সরকারি বিবাহবিধি প্রণয়নে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ম্যারেজ অ্যাক্ট থ্রি অনুসারে মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স ষোল বৎসর নির্ধারণ করে। তিনি ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। তার সভাপতিত্বে অসমের চা শ্রমিকদের দুরবস্থার সম্বন্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়। তিনি শ্রমিকদের অপমানসূচক "কুলি" শব্দ ব্যবহারে আপত্তি করেন। দেওঘরে তিনি তার স্ত্রীর নামে রাজকুমারী কুষ্ঠাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

ডা. সরকার ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার শেরিফ, অনারারি ম্যাজিসেট্রট নির্বাচিত হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁকে 'কম্পানিয়ন্স অফ দ্য অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার' (সিআইই) প্রদান করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর অব ল' উপাধি প্রদান করে।

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ২৪ পরগনা জেলার বন্দিপুর গ্রামের মহেশচন্দ্র বিশ্বাসের কন্যা রাজকুমারীকে বিবাহ করেন। তাঁদের একমাত্র পুত্র অমৃতলাল সরকারও ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের সম্পাদক হন।

ডা সরকার রাণী রাসমণির পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন— সেইসূত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ভার তাঁকে দেওয়া হয়। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার পর থেকে ডা সরকারের আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণাও পরিবর্তন ঘটে। ঠাকুরের সঙ্গে ঈশ্বরীয় কথাপ্রসঙ্গে তিনি মুগ্ধ হতেন। তিনি প্রায় প্রতিদিন ঠাকুরের কাছে আসতেন এবং প্রাণ ভরে ঠাকুর ও তার ভক্তগণের সঙ্গ দিতেন। প্রথম দিনের পর তিনি প্রাপ্য দর্শনীও নিতেন না। ক্রমে ঠাকুরের সঙ্গে তার হৃদ্যতা জন্মে এবং মানসিক শান্তি লাভ করেন। তিনি একদা জনৈক ডাক্তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরের ভাবাবেশকালে শরীরের স্পন্দনাদি যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করেন। কিন্তু ঠাকুরের নিস্পন্দভাবটিকে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারেন নি বরং তার সে ভাব লক্ষ্য করে যারপরনাই বিস্মিত হন।

তিনি বলেন - "As a man I have the greatest regard for him". শেষে তিনি সাধ্যানুরূপ চেষ্টা করেও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে সুস্থ করতে পারেন নি।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের কয়েক বছর পর ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ডা সরকার প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় ভুগতে থাকেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথি ছাড়া অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করেন নি। এমনকি মৃত্যুর বারো ঘণ্টা আগে পুত্র অমৃতলালকে জানিয়ে দেন, যেন কোনও অ্যালোপ্যাথি ওষুধ বা চিকিৎসাপদ্ধতি তার উপরে প্রয়োগ করা না হয়।

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারির সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [২] ভারতীয় রেল হাওড়া-আমতা রেলপথে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার এর জন্মস্থানের কাছাকাছি একটি স্টেশনের নাম রাখা হয় "মহেন্দ্রলাল নগর।" এছাড়াও পাইকপাড়া গ্রামে ওনার নামে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আছে। ওই গ্রামেই ওনার জন্ম ভিটেটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

নিউজজি/পি.এম

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন