শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ , ৫ জুমাদাউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

একজন বিদগ্ধ-বহুমাত্রিক শিল্পী রফিকুন নবী

নিউজজি ডেস্ক নভেম্বর ২৮, ২০২৩, ১২:০৭:১১

127
  • ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: অসাধারণ রসবোধ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সঙ্গে সমাজ-সচেতনতা ও নান্দনিক বোধের সামঞ্জস্য রেখে আমাদের চিত্রকলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অধ্যাপক রফিকুন নবী। বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রের ভুবনে শীর্ষশিল্পীদের অন্যতম। তিনি রোমান্টিকতাকে পরিহার করে ছবি আঁকেন।

এই উপমহাদেশে নক্ষত্রপ্রতীম শিল্পী তিনি। তার সৃষ্টির প্রধান গুণ হচ্ছে বাস্তবধর্মী বহিঃপ্রকাশ। তিনি জীবনের নানা অনুষঙ্গকে সন্ধান-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে নদী, নিসর্গ ও সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামকে উপলব্ধি করে তুলে ধরেছেন ক্যানভাসে। জলরং, কাঠখোদাই ও তেলরঙের কাজে তিনি যথেষ্ট পারদর্শিতা ও সিদ্ধহস্ত।

আজ ২৮ নভেম্বর শিল্পপ্রাণ নন্দিত এই কারুকারের ৭৮তম জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের এইদিনে আজকের খ্যাতনামা এই চিত্রকর-কার্টুনিস্ট চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রশীদুন নবী এবং মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। রফিকুন নবীর মাতুল ও পৈতৃক দুই পরিবারই ছিল সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।

তার পিতা রশীদুন নবী ও পিতামহ মহিউদ্দীন আহমেদ দুজনই ছিলেন পুলিশ অফিসার। পুলিশ অফিসার বাবার বদলির চাকুরির সুবাদে রফিকুন নবীর বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকা দেখার সুযোগটা তিনি পেয়েছেন ছোটবেলা থেকেই। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় থিতু হন বাবা। পুরান ঢাকাতেই কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় কাটে রফিকুন নবীর।

১৯৫০-এর মাঝামাঝিতে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। পুরান ঢাকার পোগোজ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৫৯ সালে সম্পূর্ণ পিতার ইচ্ছায় ঢাকার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন তিনি। এখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং পরে আরও কতিপয় খ্যাতিমান দিকপালের সান্নিধ্যে থেকে পড়াশোনা করেন। আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে থাকতে নিজের আঁকা ছবি প্রথম বিক্রি করেন ১৫ টাকায়।

স্থানীয় সংবাদপত্রে রেখাচিত্র এঁকে এবং বুক কভার ইলাস্ট্রেশন করে পরিচিতি লাভ করেন দ্বিতীয় বর্ষেই। ১৯৬২ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি স্নাতক পাশ করেন। পড়াশোনা শেষ করে রফিকুন নবী সে সময়ে ঢাকার প্রথম সারির পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কবি আবদুল গনি হাজারির কলাম কাল পেঁচার ডায়েরীতে৷ ১৯৬৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেন তিনি৷

ষাটের দশকের স্বরূপ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের দিনগুলো শিল্পী রফিকুন নবীর শিল্পীচৈতন্য সৃজনের যে পথ সৃষ্টি করেছিল, কালের যাত্রায় তা বেগবান হয়েছে। তার জল রং, তেল রং, রেখালেখ্য ও কাঠখোদাই হয়ে উঠেছে এ দেশের শিল্পের পথযাত্রায় বিশেষ গুণে অনন্য সৃষ্টি।

তার সৃষ্ট এক একটি ছবিতে গভীরতম বোধের শক্তিমত্তা ও চিন্তার ব্যপ্তি যে কত তীব্র, তীক্ষ্ণ ও শিল্পিত জ্ঞানে প্রভাময়, তা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে রফিকুন নবীর অনবদ্য সব শিল্পকর্মে। এদেশের শিল্পাঙ্গণে ‘রনবী’ নামের কার্টুনিস্ট হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন রফিকুন নবী।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কাপড় ও খাদ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে গ্রিক সরকারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হলেন গ্রিসের এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্ট-এ৷ পড়াশোনা করলেন প্রিন্ট মেকিং-এর ওপর৷ 

এই শিক্ষা গ্রহণ তার শিল্পচৈতন্যে নবমাত্রা সঞ্চার করেছিল।

শৈলী, রূপারোপ নির্মাণ ও রং ব্যবহারে তার ছাপাই ছবি হয়ে ওঠে নবব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। গতানুগতিক ধারামুক্ত তার কাঠখোদাই সেই সময় থেকে শিল্পরসিকদের কাছে ভিন্ন মর্যাদা লাভ করতে সমর্থ হয়। ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি৷ শিক্ষক থেকে ধীরে ধীরে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত হন৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টস-এর ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগে প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ইন্সটিটিউটের পরিচালক। বর্তমানে রফিকুন নবী ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করছেন। কিন্তু কার্টুনিস্ট হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও কার্টুনই তার একমাত্র কাজ নয়। ড্রয়িং, ছাপচিত্র, জল রং, তেল রং ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে কাজ করার পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ, পোস্টারসহ অনেক ধরনের ব্যবহারিক শিল্পকর্মের চর্চাও করছেন।

এদেশের চিত্রকলায় অধুনিকতার অনুসন্ধানে যে কজন শিল্পীর নীরিক্ষাধর্মী কাজ অপরিহার্য তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন রফিকুন নবী। তিনি আমাদের শিল্পকলার জগতের এক অনন্য বহুমাত্রিক শিল্পী। শিল্পক্ষেত্রের কর্মজীবনে রফিুকন নবী গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকা ও বইয়ের অলংকরণের কাজে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।

তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘কার্টুন’ ও ‘টোকাই সিরিজ দুটি দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। কার্টুনের বিষয়, সংলাপ, তথ্য ও সংবাদ- পাঠক ও শিল্পপ্রেমীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সমাজ বাস্তবতাকে শিল্পী এই দুটি সিরিজের মধ্যদিয়ে উপস্থাপন করেছেন। সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় শিল্পী কার্টুন আঁকা শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে ‘টোকাই’ শিরোনামের কার্টুন এঁকে ব্যাপক আলোচিত হন। এরপর থেকে ‘টোকাই’ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে।

চিত্রকলার দেশে-বিদেশে একক প্রদর্শনী নয়টি। উল্লেখযোগ্য যৌথ প্রদর্শনী একশ পনেরোটি। লেখালেখি করছেন স্কুলে পড়ার সময় থেকে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তার তিনটি উপন্যাস রয়েছে। কিশোর উপন্যাসের জন্যে অগ্রণী ব্যাংক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। প্রবন্ধ, রম্যরচনা এবং শিশুতোষ ছড়াও লিখে থাকেন।

বর্ণাঢ্য শিল্পীজীবনে কাজের স্বীকৃতি সরূপ রফিকুন নবী পেয়েছেন—রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক, চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, বুক-কভার ডিজাইনের জন্য ১৩ বার ন্যাশনাল একাডেমি পুরস্কার ৷ তার আঁকা ‘খরা’ শীর্ষক ছবির জন্য ২০০৮ সালে ৮০টি দেশের ৩০০ জন চিত্রশিল্পীর মধ্যে ‘এক্সিলেন্ট আর্টিস্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি৷ এছাড়াও ১৯৮০ সালে তিনি বার্লিনে পেয়েছিলেন চিত্রকলায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

মিরপুর জল্লাদখানা, বিটিভি,শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি জোন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিল্পীর শিল্পকর্ম স্থাপনা রয়েছে। শুধু দেয়ালেই নয়, এদেশের মানুষের মনের মাঝে তিনি ও তার শিল্পকর্ম যেই আসন গেঁড়েছেন তা অনন্ত সময় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আরও অনেকটা সময় তিনি আমাদের শিল্পকলাকে সৃজন-মননে সমৃদ্ধ করে যাবে, এই প্রত্যাশা সকলের। শুভ জন্মদিন প্রিয় চিত্রকর রফিকুন নবী।

নিউজজি/ এস দত্ত

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন