ইরফান খান: অকালে ঝরে যাওয়া বলিউডের নক্ষত্র

বলিউডের তিন খানের মতো তার নামের পাশেও রয়েছে খান। কিন্তু দর্শকদের পাগলমনা ভালোবাসা কিংবা একচেটিয়া জনপ্রিয়তা, সেসবে তিনি একটু পিছিয়েই বটে। তাতে কী! তার অবস্থান, সাফল্য আর প্রাপ্তিতে কি কমতি ছিল? একদমই না। বরং রূপালি দুনিয়া তাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। আর তিনিও সমৃদ্ধ করেছেন বলিউড নামের সিনে ইন্ডাস্ট্রিকে।

অভিনেতা শব্দটি যাদের নামের পাশে একেবারে মানানসই, সার্থক, তিনি তাদের একজন। সাবলীল অভিনয়ে তার বিকল্প খোঁজা অনর্থক। তাইতো বর্ণিল ক্যারিয়ারে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সম্মাননা।

তার শুরুটা ছিল টেলিভিশন দিয়ে। বিভিন্ন সিরিয়াল ও অনুষ্ঠানে কাজের মধ্য দিয়ে তিনি সিনে জগতে পা বাড়ান। ১৯৮৮ সালে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। নাম ‘সালাম বোম্বে’। সেই সালাম দিয়েই তিনি নজর কাড়েন। সিনেমাটি সে বছর অস্কারে পর্যন্ত মনোনীত হয়েছিল।

বক্স অফিসে সাফল্য পেতে অনেকটা সময় লেগেছিল তার। সালটা ছিল ২০০০৭। ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ দিয়ে জনপ্রিয়তা পাকা করে নেন তিনি। একইসঙ্গে সিনেমাটির জন্য তিনি পেয়ে যান সেরা পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

২০১১ সালে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যান দারুণভাবে। ‘পান সিং তোমার’ সিনেমায় একজন দৌড়বিদের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। আর সিনেমাটি তাকে এনে দেয় সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

২০১৩ সালে ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ সিনেমায় অভিনয় করে প্রশংসার জোয়ারে ভাসেন তিনি। দর্শক ও সমালোচক সবাই সার্বজনীনভাবে তার প্রশংসা করেন।

‘পিকু’ সিনেমায় তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হননি, এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সাবলীলভাবে এত নিখুঁত অভিনয় একজন মানুষ করতে পারেন, সেটা কেবল তাকে দেখলেই বোঝা যায়।

গুণী এই অভিনেতা বক্স অফিসে বড় সাফল্য পান ২০১৭ সালে। ‘হিন্দি মিডিয়াম’ নামের সেই সিনেমা চুটিয়ে ব্যবসা করেছিল। দর্শকদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতায় সিনেমাটি বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সফল সিনেমার খেতাব পায়। সেই সঙ্গে অভিনেতা পেয়ে যান ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

না, শুধু বলিউডেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তার অভিনয়ের জাদু ছড়িয়ে পড়েছিল হলিউডেও। মার্কিন মুলুকে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি সফল সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সেই তালিকায় রয়েছে ‘দ্য এমেজিং স্পাইডারম্যান’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’ ও ‘ইনফার্নো’ ইত্যাদি।

এছাড়াও সিনে দুনিয়ায় সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কারে বাজিমাত করা সিনেমা ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’-এও অভিনয় করেছেন তিনি।

অভিনয় করেছেন বাংলাদেশেও। খ্যাতিমান নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। এখানে তিনি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

এতক্ষণ ধরে যাকে নিয়ে, যার সিনেমা নিয়ে কথা বলছি, তাকে নিয়ে আরও অনেকটা সময় কথা বলা যাবে; আলোচনা করা যাবে। তিনি ইরফান খান। বলিউডের অন্যতম গুণী অভিনেতা।

আজ ২৯ এপ্রিল ইরফান খানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন কিংবদন্তি এই অভিনেতা।

ইরফান খানের জন্ম ১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি রাজস্থানের টঙ্কে। তার পুরো নাম সাহেবজাদে ইরফান আলি খান। ছোট বেলায় তিনি দারুণ ক্রিকেট খেলতেন। তবে জাতীয় দল যখন প্রায় হাতছানি দিচ্ছিল, তখনই তিনি সেটা ছেড়ে দেন।

ইরফান খান অভিনীত উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি সিনেমা হচ্ছে- ‘মকবুল’, ‘চরস: অ্যা জয়েন্ট অপারেশন’, ‘রোড টু লাদাখ’, ‘চেহরা’, ‘পার্টিশন’, ‘আজা নাচলে’, ‘মুম্বাই মেরি জান’, ‘বিল্লু’, ‘সাত খুন মাফ’, ‘সাহেব বিবি অউর গ্যাংস্টার রিটার্নস’, ‘ডি-ডে’, ‘গুন্ডে’, ‘হায়দার’, ‘জাজবা’, ‘তালবার’, ‘মাদারি’, ‘করিব করিব সিঙ্গেল’, ‘ব্ল্যাকমেইল’, ‘কারওয়ান’ ও ‘আংরেজি মিডিয়াম’।

সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ারে ইরফান খান পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি চারবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।

দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইরফান খান। তার চলে যাওয়ার পর অস্কারের মতো সর্বোচ্চ সম্মাননার আসরে তাকে স্মরণ করা হয়েছে।

বলতেই হয়, বড় অবেলায় চলে গেছেন ইরফান খান। আরও কিছু মনোমুগ্ধকর সংলাপ যদি শুনিয়ে যেতেন, কিংবা আরও কিছুক্ষণ শুধু নীরবেই না হয় বসে থাকতেন দৃশ্যে! আমরা দেখতাম, আর ভাবতাম অভিনয় বুঝি এটাকেই বলে!

২৯ এপ্রিল তারিখটি ক্যালেন্ডারের পাতায় কালো দাগ নিয়ে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে। সিনেমাপ্রেমী দর্শক আপনাকে মনে রাখবে, বলিউড নামের ইন্ডাস্ট্রি আপনাকে কুর্নিশ জানাবে, ইতিহাসের ডায়েরিতে আপনার নামেও অনেকটা জায়গা চিরকাল সমৃদ্ধ হয়ে থাকবে।

নিউজজি/নাসি