সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ , ১৭ রমজান ১৪৪৬

শিল্প-সংস্কৃতি

আমাদের সেলুলয়েডে মহান মুক্তিযুদ্ধ

ফারুক হোসেন শিহাব ২৬ মার্চ, ২০২৪, ০১:১৯:২৮

109
  • আমাদের সেলুলয়েডে মহান মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালি জীবনে শ্রেষ্ঠতম গৌরবের অধ্যায়। আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস। অগ্নিঝরা এই মার্চেই বাঙালির এই ইতিহাসের ঘোষিত যাত্রা শুরু হয়েছিল। মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন যে আলোর মশাল জ্বেলে দিয়েছিলেন, সেই মশাল হাতে পাক দোসরদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী বাঙালি। 

নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালি কোথায় পেল এত সাহস! স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে সহায়ক মুক্তিযুদ্ধের অনেক গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক নির্মিত হয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে শিক্ষক, শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক কর্মী তথা চিত্রশিল্পীর অবদান অবিস্মরণীয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ এবং মানবতা-বিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলনে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সত্যপ্রকাশে প্রণোদনা জুগিয়েছে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার চার দশকে সেলুলয়েডের ফিতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে বহু চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র। সেগুলোর কোনটি মহাকালের বিচারে উত্তীর্ণ হয়ে নাম লিখিয়েছে ক্লাসিকের খাতায়।

আবার নির্মাণশৈলী এবং গল্পের গাঁথুনির দুর্বলতায় অনেক চলচ্চিত্র মানুষ আর মনে রাখেনি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বিপুলসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। অনেক যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা বিবেকের তাড়নায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ দেশের মানুষের আবেগ ও অনুভূতিটা একটু বেশিই। 

বাংলাদেশী হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশের আপামর জনতা সব সময়ই হৃদয়ের গভীরে লালন করেন। আমাদের অহংকারের মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যম হিসেবে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে দেশীয় চলচ্চিত্র। 

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা এগারো জন’। সিনেমার অধিকাংশ কলাকুশলী ছিলেন তখনকার সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বাংলার সূর্যসন্তান। দর্শক টান টান উত্তেজনা নিয়েই উপভোগ করেছে সিনেমাটি। এ ছাড়াও মুক্তি পায় সুভাস দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও আনন্দের ‘বাঘা বাঙালি’। যুদ্ধাহত নবীন বাংলাদেশে যুদ্ধের পরের বছরই এ চলচ্চিত্রগুলো মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধের তাণ্ডবের সাথে সরাসরি যুক্ত সবাই তখন পর্দায় উপভোগ করে তাদের কীর্তিগাঁথা।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’। ওই বছরই ‘আমার জন্মভূমি’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন আলমগীর কুমকুম। খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ জীবনে ফিরে এসে দেশ গঠনের কাজে নিয়োজিত হওয়ার আহ্বান করা হয়েছে এ সিনেমায়। ১৯৭৩ সালে এই তিনটি সিনেমার পর ১৯৭৪ সালে চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘সংগ্রাম’ মুক্তি পায়। ৭৪ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরেকটি সিনেমা, মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’। 

১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় হারুনুর রশীদ পরিচালিত ‘মেঘের অনেক রঙ’। ৭০-এর দশকেই নির্মিত হয় ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয় বাংলা’, এস আলী পরিচালিত ‘বাঙালির ছাব্বিশ বছর’। আলমগীর কবির নির্মাণ করেছেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ আর শহীদুল হক খান নির্মাণ করেছেন ‘কলমিলতা’। নব্বইয়ে দশকে এসে বেশ কিছু গুণী চলচ্চিত্রকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ ভালো কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন।

তারেক মাসুদ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের পর নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। প্রশংসিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ সিনেমাটি সব মহলে প্রশংসিত হয়। আর এটাই বাংলাদেশের প্রথম অস্কারের জন্য মনোনীত কোনো চলচ্চিত্র। এতে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। 

১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তৃতীয় সিনেমা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ আর তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র ‘খেলাঘর’। এতে মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি দেখানো হয়নি একবারও, তবুও যুদ্ধের উত্তাপ ছিল প্রতি মুহূর্তে। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ রকম বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে আমাদের দেশে। যদিও বিশ্বমানের চলচ্চিত্র খুব একটা হয়নি বলেই অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকদের ধারণা।

তবুও সব নির্মাতাই চেষ্টা করেছেন নিজ নিজ জায়গা থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়েই প্রগতিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। জহির রায়হান নির্মাণ করেন অনন্য সিনেমা ‘স্টপ জেনোসাইড’, যা বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্য চলচ্চিত্রগুলো হলো আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, শুকদেবের ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ ও বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।

যুদ্ধের ময়দান থেকেই বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সাথে সাথে প্রামাণ্যচিত্রের ইতিহাস শুরু হয়। ১৯৭২ সালে নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’। ১৯৮৪ সালে নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’, ১৯৮৬ সালে ‘প্রত্যাবর্তন’। এর পরিচালক ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম। আর এই গুণী পরিচালকের হাতেই ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় ‘সূচনা’।

১৯৮৯ সালে আক্তার হোসেন নির্মাণ করলেন ‘দুরন্ত’। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরে নির্মিত হয়েছে আরও বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ১৯৯০ সালে নির্মিত হয় ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘ধূসর যাত্রা’। ১৯৯৩ সালে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন ‘একাত্তরের যীশু’। ২০০৪ সালে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন ‘স্মৃতি ৭১’। এর আগের বছর কাওসার চৌধুরী তৈরি করেন ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’। এ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি দর্শক ও সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। 

এরপর আরও বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হলেও সবচেয়ে আলোচনায় আসে ‘গেরিলা’। ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এই চলচ্চিত্রটি মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। 

‘গেরিলা’ সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন সহস্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ।  

গেরিলার পর ২০১১ সালেই মুক্তি পায় রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেহেরজান’, ২০১২ সালে শাহজাহান চৌধুরীর ‘আত্মদান’, আনোয়ার শাহাদাতের ‘কারিগর’, ‘বদরুল আনাম সৌদ এর ‘খণ্ড গল্প ৭১’, মাসুদ আখন্দের ‘পিতা’, ২০১৩ সালে মুক্তি পায় তানভীর মোকাম্মেল এর ‘জীবনঢুলী’,মিজানুর রহমান শামীমের ‘৭১ এর গেরিলা’, ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নির্মিত হয় ছয়টি চলচ্চিত্র। 

এরমধ্যে রয়েছে মনসুর আলীর ‘৭১ এর সংগ্রাম’, জাহিদুর রহমান অঞ্জনের ‘মেঘম্লার’, গোলাম মোস্তফা শিমুলের ‘অনুক্রোশ’, সাদেক সিদ্দিকীর ‘হৃদয়ে ৭১’, শাহ আলম কিরণের ‘৭১ এর মা জননী’, মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত এর ‘যুদ্ধশিশু’, ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নির্মিত হয় তিনটি চলচ্চিত্র। এগুলো হলো সোহেল আরমানের ‘এইতো প্রেম’, মানিক মানবিকের, ‘শোভনের স্বাধীনতা’, মোরশেদুল ইসলামের ‘অনিল বাগচীর একদিন’। 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন