শুক্রবার, ২ জুন ২০২৩, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ , ১৩ জিলকদ ১৪৪৪

শিল্প-সংস্কৃতি

আমাদের মঞ্চে নজরুলের নাটক অপ্রতুল

ফারুক হোসেন শিহাব ২৫ মে, ২০২৩, ১১:৫৫:১৪

85
  • আমাদের মঞ্চে নজরুলের নাটক অপ্রতুল

ঢাকা: জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আমাদের সাহিত্য-সঙ্গীত তথা বাংলা সংস্কৃতির অনন্য স্রষ্টা। তিনি প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি। শুধু কবিই নয় তার লেখনী ধূমকেতুর মত আঘাত হেনে আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল বারংবার। রণাঙ্গনে, রঙ্গালয়ে, কারাগারে, চলচ্চিত্রে, নাটকে, রেডিওতে, মঞ্চে, কবিতায় এমনকি সাংবাদিকতাসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় সকল শাখায় বিরল কালোত্তীর্ণ এক নাবিকের নাম নজরুল। 

আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মান দিয়েছি সত্যি, কিন্তু তার সৃষ্টিভাণ্ডার নিয়ে যতটা কাজ করা দরকার তা কোনভাবেই করা হয়নি। তিনি যে বৈচিত্র্য এবং বিপুল রচনাসম্ভার নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছিলেন তার অনেক কিছুই আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে। বালক বয়সে কবি নজরুল ছিলেন লেটো দলের সর্দার। নাটক রচনার মাধ্যমেই মূলত তার বিস্ময়কর, সৃষ্টিশীল জীবনের যাত্রা।

‘যাত্রা’ রচনার মাধ্যমে যার কালজয়ী অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সেই মহাকবি তার পরবর্তী সৃষ্টিশীল জীবনে মঞ্চনাটক, রেকর্ড নাটক, বেতার নাটক ও সিনেমায় যে বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভার সংযোজন করেছেন তা আজো অনেকাংশে অনাবিষ্কৃত। নাটকের মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধের জাগরণ ও মহত্তর কল্যাণবোধের উত্তরণের জন্যে, উপেক্ষিত লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত আত্মবিস্মৃত ব্যক্তিকে চেতনা-সম্পন্ন করতে চেয়েছে নজরুল।

তার রচিত নাটক-নাটিকা ও নাট্যধর্মী রচনার সংখ্যাও কম নয়। বিচিত্র আঙ্গিক, বিচিত্র বিষয় নজরুল একাঙ্ক নাটক, পূর্ণাঙ্গ নাটক, কাব্যনাটক, শুধুমাত্র বাচ্চা মেয়েদের অভিনয় উপযোগী নাটক এমনকি রেডিওর জন্য অজস্র গীতিনাট্য লিখেছেন। বিশুদ্ধ রঙ্গ-কৌতুকের নাটকও লিখেছেন নজরুল।

মানুষ হিসেবে হিন্দু-মুসলমানে ফারাক করেননি তিনি। সেই দর্শন তার নাটকেও ফুটে উঠেছে। তিনি মুসলমানদের জন্য লিখেছেন ঈদের নাটক ‘ঈদ'। আবার সম্পূর্ণ হিন্দিতে হিন্দুদের জন্য নাটক লিখেছেন ‘জন্মাষ্টমী’। নজরুল বাংলা নাট্যরচনার ধারায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যের সঙ্গীতময়তাকে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতে পেরেছেন। কারণ নজরুলের নাটকের ভাষা গীত ও কাব্যের যুগলবন্দীতে আবৃত।

তার নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। তিনি বাঙালির রক্তে বিপ্লবের তেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যতদিন পৃথিবীতে একজন বীর বাঙালি বেঁচে থাকবেন ততদিন তার রক্তে, তার হৃদয়-স্পন্দনে প্রতিধ্বনিত হবে নজরুলের অনবদ্য বিদ্রোহী চেতনা। অথচ, আমরা এই কালোত্তীর্ণ কবির কর্মযজ্ঞকে সব সময়ই নানাভাবে উপেক্ষিত করেছি। তাকে আমরা কতটাই বা জানতে পেরেছি কিংবা জানার চেষ্টা করেছি। শুধুমাত্র নজরুলের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর সময়টায় প্রতি বছরই টিভি চ্যানেল আর পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে বিশেষ আয়োজনের হিড়িক পড়ে যায়। বাকিটা সময় তিনি পড়ে থাকেন অন্তরালে।

কবি নজরুল রচিত নাটকের সংখ্যা শতাধিক হলেও হাতেগোনা কয়েকটি নাটকই আমাদের কাছে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- আলেয়া, মধুমালা, বিদ্যাপতি, পুতুলের বিয়ে, জাগো সুন্দর চির কিশোর, শ্রীমন্ত, বিষ্ণুপ্রিয়া, বনের বেদে, ঝিলিমিলি, সেতু–বন্ধ, ভূতের ভয় ইত্যাদি। 

তুলনামূলকভাবে নজরুল সঙ্গীতের যতটা চর্চা হচ্ছে তার নাটক বা অন্যসব সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে ততটা কাজ হচ্ছে কি? তার নাটক নিয়ে টেলিভিশনে যতখানি কাজ হয়েছে, সে অর্থে মঞ্চরূপ নাটকের সংখ্যা একবারের নগণ্য।

এ পর্যন্ত যেসব নাটকের দল নজরুলের নাটক নিয়ে কাজ করেছেন তার মধ্যে ১৯৮৮ সালে সিরাজউদ্দৌলা থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘রূপান্তর’ ও ‘অগ্নিগিরি’, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামের নাট্যদল তির্যক মঞ্চে আনে নজরুলের কবিতা অবলম্বনে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, একই দল ৯৯-এ মঞ্চে আনে ‘মধুমালা’। ওই বছর ‘ভূতের ভয়’ মঞ্চে তোলে হবিগঞ্জের দল নাট্যমেলা। ২০০১ সালে প্রতিবিম্ব থিয়েটার আনে নজরুলের ‘ভিক্ষে দাও’।

২০০২-এ বি.বাড়িয়ার দল সাহিত্য একাডেমি মঞ্চাঙ্গনে আনে ‘রাক্ষুসী, একই সময়ে লোক নাট্যদল টিএসসি মঞ্চে আনে ‘ঝিলমিল’। ২০০৮ সালে ‘মধুমালা’ মঞ্চে আনে লোক নাট্যদল সিদ্ধেশ্বরী। এ ছাড়াও নজরুলের ‘মানুষ’ ও ‘রাক্ষুসী’ মঞ্চে তোলে চাঁদপুরের দল অনন্য নাট্যগোষ্ঠী, বগুড়া থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘দ্রোহ’, ।

কাজী নজরুল ইসলামের গীতিনাট্য ‘আলেয়া’ অবলম্বনে ২০১০ সালের ১৭ জুন প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনে নাটক ‘দ্রোহ প্রেম নারী’। রাজা মীনকেতু আর অন্য দেশের রানী জয়ন্তীকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘দ্রোহ প্রেম নারী’ কাহিনি। ২০১১ সালে এসে ঢাকার দল জেনেসিস থিয়েটার মঞ্চে আনে নজরুলের জীবনীভিত্তিক নাটক ‘দামাল ছেলে নজরুল’।

নজরুলের ‘সাপুড়ে’ গল্প অবলম্বনে ২০১৫ সালের  ১৪ আগস্ট মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘নীলাখ্যান’। সর্বস্তরে নাটকটি ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাদের মঞ্চে নজরুলের বেশকিছু শিশুকিশোর নাটক হয়েছিল। কিন্তু তা একেবারেই অপ্রতুল এবং হাতেগোনা কয়েকটি প্রদর্শনীর পর নিয়মিত হতে পারেনি। তবে এরই মধ্যে নজরুলের নাটক নিয়ে অনেক নাট্যদলই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। 

এ বিষয়ে শিশু-কিশোর নাট্যান্দোলনের পথিকৃৎ নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘নজরুল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন মাধ্যম নেই, যেখানে তার কৃতিত্ব নেই। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার প্রভাবিত বিচরণ রয়েছে। তার সৃষ্টিসম্ভার বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নবতর যুগের নিদর্শন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গানে যেমনি ছিল তার অসাধারণ শিল্পগভীরতা, তেমনি নাটকের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অতুলনীয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে নজরুল নাট্যচর্চা হয়নি। টেলিভিশনে এবং শিশু-কিশোর নাটকে যতটা নজরুলচর্চা হয়েছে সে তুলনায় আমাদের মঞ্চে নজরুল অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের আরও আন্তরিক হওয়া জরুরী। তা না হলে আমাদের জাতীয় কবির প্রতি অশ্রদ্ধা-অমর্যাদাই করা হবে।’ 

সাহিত্যনির্ভর নাট্যচর্চায়ও নজরুলের সাহিত্য যেন অনেকটা অবহেলিত। ঢাকার মঞ্চে সাহিত্যনির্ভর নাটকে নজরুল নিয়ে কিছু কাজ হলেও সেগুলো মান ও সংখ্যার বিচারে একেবারেই অপ্রতুল। সার্বিক অর্থে আমাদের নাট্যমঞ্চে নজরুল কমই চর্চিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নাট্যসংগঠন নজরুলের কবিতা-গল্প অবলম্বনে নাটক মঞ্চে আনলেও তার রচিত মূল নাটকগুলোই রয়ে গেছে অন্তরালে।

নজরুলের সাপুড়ে অবলম্বনে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি নিয়ে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বলেন, ‘নাটকের কাহিনির প্রেক্ষাপট বেদে-বহর হলেও কবি নজরুল অন্তভ্রোতে এমন একটি সর্বজনীন বীজ ভাসিয়ে দিয়েছেন যা স্পষ্টতই গোটা মানবজাতির সর্বকালকে ছুঁয়ে যায়।’ 

নজরুলের নাটকের আরেক অভিনেতা-নির্দেশক রামিজ রাজু বলেন, ‘নজরুলের সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শুরুতে একটু কঠিনই মনে হয়েছে পরে দলের সবাই বেশ সহযোগিতা করেছে। নাটকটি মঞ্চে আসার পর সবার প্রশংসা পেয়েছি। এই কাজটি করতে গিয়ে জানতে পেরেছি তাঁর সুবিশাল নাট্যভাণ্ডারের কথা। যা সেভাবে চর্চিতই হয়নি, এমনকি অনেক নাটক এখনো অনাবিষ্কৃত কিংবা যথার্থ সংরক্ষণই হয়নি। এটি সত্যি আপসোসের বিষয়।’ 

পরিশেষে বলবো, আমাদের নাট্য-ঐতিহ্যকে আরো প্রস্ফুটিত করতে হলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীনদের মত সাহিত্যিক ও নাট্যকারদের নাটক এবং তাদের নাট্য সংশ্লিষ্ট অবদানকে রীতিমতো চর্চার পাশাপাশি আবিষ্কার, পুনরাবিষ্কার করা জরুরী। নজরুলকে জাতীয় কবির যে সম্মান দেয়া হয়েছে, সেটি শুধুই কাগজে-কলমে না রেখে অন্তত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় যেন তাদের সুবিশাল সৃজনভাণ্ডারের প্রতিফলন ঘটে। এমন প্রত্যাশাই সকলের।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন