বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ , ১৭ জুমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সংস্কৃতি

সলিল চৌধুরী: গণমানুষের প্রতিনিধি কিংবা গণসঙ্গীতের পথিকৃৎ

নিউজজি প্রতিবেদক ১৯ নভেম্বর, ২০২২, ১১:৩১:১১

238
  • সলিল চৌধুরী: গণমানুষের প্রতিনিধি কিংবা গণসঙ্গীতের পথিকৃৎ

যে গান গণমানুষের কথা বলে, যে গানে কণ্ঠ মেলায় দেশ-সমাজের সাধারণ মানুষ, যে গানে উঠে আসে নিগৃহীত, বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদের ভাষা; সেই গানের প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। আর তাই তাকে বলা হয় গণসঙ্গীতের প্রণেতা।

বলছি কালজয়ী গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর কথা। উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের জন্মদিন আজ। ১৯২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

সলিল চৌধুরীর জন্ম আসামের রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজীপুরে। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের ডাক্তার। তিনি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাই বাবার কাছেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় সলিল চৌধুরীর। পরবর্তীতে নিখিল চৌধুরীর কাছেও তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষ গ্রামে (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন সলিল চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তার পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটক করে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্বতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জন্মায়।

সেসময় তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ (ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন)-এ যোগ দেন। তখনই গান লিখতে ও সুর করতে শুরু করেন সলিল চৌধুরী। সেসময় আইপিটি-এর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর ও গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মতো গান। যা তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

তার ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল। পশ্চিমবঙ্গে তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। এরমধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্বিক্ষ তথা পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’, ‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তার লেখা গণসঙ্গীত অনুপ্রাণিত করতে থাকে ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। গণসঙ্গীতের সর্বজনীন আবেদন বারবার এসেছে তার গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায়।

চলচ্চিত্রেও তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো বিঘা জমিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলের মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

সলিল চৌধুরী প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র এবং বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

তার ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’ যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। সলিল চৌধুরীর ছোটগল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে, যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। সলিল চৌধুরী সেরা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ১৯৫৮ সালে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। এছাড়া, ১৯৮৮ সালে তিনি সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সলিল চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন চিত্রশিল্পী জ্যোতি চৌধুরীকে। এই সংসারে তাদের তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা হলেন আলোকা, তুলিকা ও লিপিকা। পরবর্তীতে গায়িকা সবিতা চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সলিল চৌধুরী। সলিল ও সবিতার ঘরে সুকান্ত ও সঞ্জয় নামের দুই পুত্র এবং অন্তরা ও সঞ্চারী নামের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।

নিউজজি/রুআ/নাসি 

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন