বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ , ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সংস্কৃতি

বাচিক শিল্পের এক অপ্রতিরুদ্ধ বাতিওয়ালা নরেন বিশ্বাস

ফারুক হোসেন শিহাব ২৭ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৫:৩০

195
  • বাচিক শিল্পের এক অপ্রতিরুদ্ধ বাতিওয়ালা নরেন বিশ্বাস

ঢাকা : মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে জীবন্ত ও বহমান। যে কারণে সময়ের বিবর্তনে ভাষার পরিবর্তন হয়। সুতরাং, আজকের মুখের ভাষার সঙ্গে শতবর্ষ পরের ভাষার কিছু পার্থক্য ঘটে যেতে পারে। কিন্তু চলিত-প্রমিত ভাষার ব্যবহারে অধিকাংশ মানুষের উচ্চারণ ত্রুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। 

তাহলে কিভাবে বাংলা প্রমিত উচ্চারণে অভ্যস্ত হওয়া যায়, কিভাবে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়? আসলে আমাদের প্রমিত উচ্চারণে মূল সমস্যাটা কোথায়? সেই সূত্রগুলোকেই যিনি অতি সহজতর করে এদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, তিনি বাচিক শিল্পের একজন বিদগ্ধ মানুষ।

বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারিত রূপের জন্য তার আত্মত্যাগ, নিরলস কর্ম পরিচালনা, সকল কিছু ভুলে গিয়ে শুধু ভাষা নিয়েই তার নিবিড় গবেষণা । বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, প্রতি শুক্রবারের কণ্ঠশীলনের ক্লাস, বিভিন্ন আবৃত্তি ও নাটকের দলের ক্লাস-এ তার কোনো বিরতি ছিলো না। তিনি শিল্পের এক অপ্রতিরুদ্ধ যোদ্ধা।

বলছি, বাচিক শিল্পের কীর্তিমান শিল্পী, সংগঠক এবং গবেষক নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস-এর কথা। মুক্তিযুদ্ধের এই বীরসেনানী একাধারে একজন লেখক, গবেষক, আবৃত্তি শিল্পী। আবৃত্তি চর্চায় তার নিপুণতা এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক বই লেখার জন্য তাকে বাকশিল্পাচার্য বলা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা উচ্চারণ সংস্কারে উদ্যোগী, বাচিক শিল্প বিশেষজ্ঞ, গবেষক, লেখক ও একজন জনপ্রিয় অধ্যাপক। 

আজ ২৭ নভেম্বর দেশের আবৃত্তিশিল্পের এই পথিকৃতের প্রয়াণদিবস। ১৯৯৮ সালের এইদিনে গুণী এই শিল্পচারী না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বাংলা উচ্চারণ গবেষণায় তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য আজও তিনি উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা হিসেবে আমাদের শিল্পসমাজে সমাদৃত।

নরেন বিশ্বাস ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাঝিগাতীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নগেন্দ্র নাথ বিশ্বাস আর মাতা হরিদাসী বিশ্বাস। নরেন বিশ্বাস গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দী মিড হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, শ্রীকৃষ্ণ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৬৬ সালে এম.এ পাস করেন।

নরেন বিশ্বাসের নাট্যচর্চা শুরু হয় ছাত্র জীবন থেকেই। স্কুলে ও কলেজে আবৃত্তি ও বাগ্মিতায় নানা পুরস্কার লাভ করেন। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নানা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাস করেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। একবছর ময়মনসিংহের পাকুন্দিয়া কলেজ, ১৯৬৭-৭৬ সাল পর্যন্ত মাদারিপুর নাজিমউদ্দিন কলেজ ও ১৯৭৬ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে পাকবাহিনীর হাত এড়িয়ে কোনোক্রমে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতে এসে কলকাতায় পৌঁছান। এসময় বাংলা বেতারের জন্য ‘নাটক’, ‘কথিকা’, ‘জীবন্তিকা’, ‘নক্সা’ প্রভৃতি রচনা ও তাতে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সঙ্গেও তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। 

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে গোর্কির ‘মাদার’ অবলম্বেনে ‘মা’ নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন করেন। ১৯৭৪ সালে তিন মাস কারাবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন নাটক, আবৃত্তি ও কথনশিল্পের প্রশিক্ষক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।

একসময় তিনি চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। প্রায় অন্ধ চোখে অন্যের হাত ধরেই চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলে যেতেন কেবলমাত্র উচ্চারণের ক্লাস নিতে। তখন দেশে আর কোন উচ্চারণ বিশারদ ছিল না ? কাঠ-কাঠ ক্লাসটিকে মধুর করে শিক্ষার্থীর হৃদয় পর্যন্ত নেয়ার কাজটি হয়ত অনেকে করতেও পারতেন না।

সেটি পারতেন কেবল নরেন বিশ্বাসই। তার ক্লাসে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা এবং আনন্দ দুটোই গ্রহণ করতেন। এত সহজ-সরল-নির্মল নির্মাণের উচ্চারণ বিধান মুখে মুখে ফোটাতে আর কে পারে? এই বুদ্ধির জগতে সকলে যখন ইমারত-লালসায় উন্মুখ তখন কথা বলতে যেয়ে কার উচ্চারণের কী হল তার খবর কে রাখে? আর সেই সূত্রাবলীর পর্বত-অক্ষর জ্ঞানই বা অর্জনের কী মানে যদি অন্য সবকিছু দিয়ে এই ভুল ঢেকে দেয়া যায়। 

সব প্রশ্ন উল্টোবাণে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে পড়ে যখন নরেন বিশ্বাস তার ঐশ্বর্যময় স্বরের দ্বার খুলতে আরম্ভ করতেন এক এক করে। এই বিস্ময়কর সৃষ্টির ফল এই সমাজ এখন বহন করছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রীয় সুরুচি প্রকাশের মাধ্যম এই ভাষাটির প্রকাশ আজ আন্তরিক হয়েছে এবং যাদের কারণে, তাদেরই অন্যতম প্রধান বাকশিল্পাচার্য অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। তিনি বাচিক শিল্পের এক বিদগ্ধ বাতিওয়ালা। সারাদেশে ঘুরে ঘুরে আলো ছড়িয়েছেন, মুখে মুখে শুদ্ধতার মশাল জ্বেলেছে এক নিমগ্ন ও ঐকান্তিক শিল্পসাধনায়।

সাহিত্য চর্চায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তবে প্রকাশনার অধিকাংশই ছিল ভাষা ও উচ্চারণের উপর। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘বাংলা উচ্চারণ অভিধান’, ‘প্রসঙ্গ বাংলাভাষা’, ‘প্রসঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি’, ‘ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব’, ‘কাব্যতত্ত্ব অন্বেষা’, ‘অলঙ্কায় অন্বেষা’, ‘বাংলা উচ্চারণ সূত্র’, ‘বাংলা উচ্চারণ তত্ত্ব ও প্রয়োগবিধি তত্ত্ব’ প্রভৃতি। নাটক-‘নিহত কুশীলব’; ‘রৌদ্রদিন’, ‘ক্রুশবিদ্ধ যীশু’, ‘তমসীর ফাঁসি’, প্রভৃতি। 

এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে তার ২০টি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঐতিহ্যের অঙ্গিকার’ শিরোনামে ১৩টি ক্যাসেটগুচ্ছের জন্য তিনি ১৯৯৪ সালে কলকাতার ‘আনন্দ পুরস্কার’ -এ ভূষিত হন। এছাড়া ‘প্রিয় পঙক্তিমালা’ ও ‘উচ্চারণ শিক্ষা বিষয়ক বক্তৃতামালা ক্যাসেট দু’টিও উল্লেখযোগ্য।

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন