বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ , ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দেশ
  >
জনপদ

জীবন বাজি রেখে ডাকাতদের ধরে কারাগারে পাঠালেন এসআই ফরিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক ২৬ সেপ্টেম্বর , ২০২২, ১৪:৪৬:৩৭

163
  • ছবি : নিউজজি

ঢাকা: মাদক ও চোরাচালানের রুট হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে দুই ডাকাতকে ধরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছেন এসআই শেখ ফরিদ।

আজ সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এই তথ্য জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা  এসআই শেখ ফরিদ। যিনি নিজেই দুই ডাকাতকে ধরে আদালতে সোপর্দ  করেন।

শেখ ফরিদ বলেন, আদালত দুই আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছে। আর ডাকাত দলের অন্য সদস্যদের ধরার চেষ্টা চলছে।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত ২০ সেপ্টেম্বর আমি  দুই সহকর্মীসহ নিয়মিত রাত্রিকালীন জরুরী ডিউটি করছিলাম। ডিউটির এক পর্যায়ে আমরা ধনিয়াকাটা বাজার হতে বারবাকিয়া বাজারগামী রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম। সেখানে নির্জন জায়গা, দুই পাশে শুধু ধান ক্ষেত আর অন্ধকার।

এমন সময় রাস্তার মাঝখানে পৌঁছামাত্র দেখতে পাই যে, কড়ইগাছের নিচে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, আমার ডিউটিরত সিএনজির লাইটের আলো পড়ামাত্র বিষয়টা পরিষ্কার  হল যে, এটি একটি পিক আপ ট্রাক। ট্রাকটি সম্পূর্ণ পথরোধ করে আছে এবং কেউ একজন হাঁটুগেড়ে বসে মাথা নুঁয়ে গাড়ির চাকা মেরামত করছিল। তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত আড়াইটা। আমরা পিক আপ ট্রাকটির কাছাকাছি গেলাম এবং অনুমান ৫-৬ হাত দূরত্বে সিএনজি থামিয়ে সিএনজি গাড়িতে ড্রাইভারের সাথে সামনে বসে থাকা আমি এবং ঠিক আমার পেছনে বসে থাকা সহকর্মী মাহফুজসহ নামলাম। এমন সময় হঠাৎ করে রাস্তায় হাঁটুগেড়ে বসে মাথা নুইয়ে  থাকা লোকটি এক লাফে আমার সামনে এসেই বুকে বন্ধুক ঠেঁকিয়ে ধরে।

জানা যায়, এই দৃশ্য দেখে কনস্টেবল মাহফুজ এক লাফে রাস্তা থেকে পাশের ধান ক্ষেতে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে। তখন মূহুর্তের মধ্যে নিরুপায় হয়ে বাঁচার জন্য আমি জোরে এক লাফ দিয়ে লোকটির পেছনে গিয়ে তাকে আমার বুকের সাথে  ঝাপটে ধরে তার বন্ধুকের নলের মাঝখানে দুই হাতে ধরে উপরের দিকে ধরলে লোকটি এক রাউন্ড ফায়ার করে। এতে সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারলাম তিনি ডাকাত দলের সদস্য।

এতোটুকু ঘটনা ঘটে গেল ২-৩ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে। এমন সময় আমার গাড়ির ড্রাইভার একজন ডাকাতকে তার পাশে থাকা মোটা একটি লাঠি দিয়ে ঘাড়ে বাড়ি (আঘাত) করলে সে ঘুরতে ঘুরতে ধান ক্ষেতে পড়ে যায়। তাকে ধরতে গেলে উঠে দৌড়ে পিছু হটে। বাকি কনস্টেবল রিপন দাস তার সরকারি চায়না অস্ত্র ডাকাত দলের দিকে গুলি করার উদ্দেশ্য তাক করলে সবাই দৌড়ে  ১০০-১৫০ মিটার দূরত্বে অবস্থান নেয় এবং আমাদের গুলি করার হুমকি দিতে থাকে কিন্তু আর তারা পিছু হঠছে না।

 কারণ আমি তাদের একজন সদস্যকে অস্ত্রসহ আটকে রাখি এবং তাকে অস্ত্রসহ আটকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার ফোর্স গুলিও করতে পারছিল না, কারণ আমি আর ডাকাত সদস্য ধস্তাধস্তি করছিলাম। ধস্তাধস্তির মাঝে আমার হাত থেকে ডাকাতের অস্ত্র ছুটে যায়। আমি ভাবলাম ডাকাতের হাতে অস্ত্র চলে গেল। এবার নিশ্চিত মৃত্যু। তাই আমি মূহুর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে সিএনজির বিপরীত পাশে আত্মরক্ষার জন্য অবস্থান নিতে গেলে দেখতে পাই যে, ডাকাত দৌড়ে পালাচ্ছে। এমন সময় আমি আমার অফিসার ইনচার্জকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সাংবাদ দিয়ে পুনরায় মোবাইলের মাধ্যমে ফোন করে বলি ডাকাত আমাদের আক্রমণ করেছে এবং আমি স্ব-জোরে গলা ছেড়ে চিৎকার করে গ্রামবাসীকে বলতে থাকলাম, এলাকায় ডাকাত পড়েছে। পুলিশকে আক্রমণ করেছে। আমরা বিপদে আছি। আপনারা বাহির হয়ে আসেন। চারদিক ঘেরাও করেন আমাদেরকে সাহায্য করেন। কিন্তু কেউ বাহির হয়ে আসেনি মহাবিপদে এতোটুকু সাহায্য করার জন্য। আমি তখন চিৎকার দেয়ার মতো শরীরে আর জোর পাচ্ছিলাম না।

তখনই রাস্তার উপর হাঁটুগেড়ে বসে আমার বুকে চাপ দিয়ে, পেটের নাড়িতে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে চিৎকার দিতে থাকলাম। এরই মধ্যে  অফিসার ইনচার্জ অন্য টহল পার্টিকে সাহায্য করার জন্য আসতে বললেও পার্টি দূরে অবস্থান করায় আসতে ২৫ মিনিট দেরি হলো। কিন্তু ডাকাত তো আর যাচ্ছে না। কারো সাহায্য ও পাচ্ছি না। এরই মাঝে গ্রামবাসী ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেকে যারযার ঘরের দরজা-জানালায় অবস্থান নিলে, কোন ডাকাত সদস্য কারো বাড়িতে, বাগানে বা ঝোপঝাঁড়ে অবস্থান নিতে পারে নাই।

ফলে ডাকাত কারো বাড়িতে কোথাও অবস্থান না নিতে পারায় রাস্তা ধরে দৌড়াচ্ছিলো। সাধারণ লোকজন ও নাইটগার্ড এগিয়ে আসতে চাইলে ডাকাত তাদের বুকেও বন্ধুক তাক করে এবং বলে এগিয়ে আসলে গুলি করবো। পরে লোকজন আমাদের দেখতে পেয়ে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার আগেই আমি ফোর্সসহ সিএনজি যোগে বারবাকিয়া ইউপি হইয়া শিলখালী ইউপি পেরিয়ে পেকুয়া সদর ইউপিস্থ আব্দুল হামিদ সিকদার পাড়ায় ঢুকি। সেখানে ডাকাত বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। যখন চারদিক থেকে পাবলিকসহ তাদেরকে ঘেরাও করি এবং গুলি করার ভয় দেখাই, তখন তারা বলে আমাদেকে মারবেন না। অস্ত্রসহ একজন ধান ক্ষেতে শুয়ে পড়ে এবং অন্যজন পুকুরপাড়ে থাকা জঙ্গলের ভিতরে শুয়ে থাকলে পাবলিকসহ তাদেরকে (দুই জনকে) গ্রেপ্তার করি। তাদের দেখানো মতে একটি ওয়ান শুটার ৫-গান উদ্ধার করে জব্দ  করি। পরবর্তীতে তাদেরকে নিয়ে মূল ঘটনাস্থলে ফিরে আসি  এবং পিকআপ ট্রাকে থাকা চারটি গরু, পিক আপ ট্রাক, ৪২ ইঞ্চি লম্বা বড় একটি ছোরা ও ডাকাতি সরঞ্জাম  জব্দ করি। এরইমধ্যে অফিসার ইনচার্জ ও অন্যান্য পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে চলে আসে।

পরবর্তীতে তাদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি যে, তারা আরো ৮ জন ডাকাত সদস্য রয়েছে এবং পালিয়ে গেছে। আমি আমার বুকে ও হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় অফিসার ইনচার্জ আমাকে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান এবং অন্যদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা করান।পরবর্তীতে থানায় পৃথক পৃথকভাবে দুটি মামলা দায়ের  করা হয়। আমি নিজে বাদী হয়ে অস্ত্র মামলা দায়ের করি।গরুর প্রকৃত মালিক গরু সনাক্ত করে ডাকাতি মামলার এজাহার দায়ের করেন। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ডাকাতের সাথে যুদ্ধ করে নিজের কাছে মনে হলো, "মায়ের পেট থেকে নতুন করে জন্ম গ্রহন করলাম"। আল্লাহর অশেষ বরকতময় নেক রহমতের সাহায্যের জন্যই ফিরে পেলাম নতুন জীবন।

নিউজজি/এমএফ

পাঠকের মন্তব্য

লগইন করুন

ইউজার নেম / ইমেইল
পাসওয়ার্ড
নতুন একাউন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে এখানে ক্লিক করুন